কুঋণে পরিণত হচ্ছে বিশেষ ছাড়ের ঋণ

0

বছর সাতেক আগে বিশেষ ছাড় নিয়ে ১১ শিল্প গ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের নামে খেলাপি মুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় ওই সব ঋণ এখন খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি শিল্পগ্রুপের ঋণ আদায় অযোগ্য কুঋণে পরিণত হয়েছে। সবমিলে এসব ঋণ সুদে-আসলে মিলে প্রায় ডিসেম্বর শেষে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এসব শিল্প গ্রুপের ঋণ কেন মন্দ ঋণে পরিণত হলো তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। একই সাথে যথাযথ কারণ জানাতে না পারলে ওই সব খেলাপি ঋণের বিশেষ সুবিধা তুলে নেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুনর্গঠিত এসব ঋণের সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা শেষে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর শেষে ১১ এ শিল্প গ্রুপের ঋণ সুদে-আসলে বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ছয় হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, এসএ গ্রুপের এক হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, শিকদার গ্রুপের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, এনন টেক্সের এক হাজার ২০১ কোটি টাকা, রতনপুর গ্রুপের এক হাজার ২০০ কোটি টাকা, কেয়া গ্রুপের ৮৫২ কোটি টাকা, আব্দুল মোনেম গ্রুপের ১৭০ কোটি টাকা রয়েছে। এর বাইরে যমুনা, থার্মেক্স, বিআর স্পিনিং, রাইজিং স্টিলের ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিশেষ সুবিধায় ছাড় পাওয়া এ ১১ গ্রুপের ঋণের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এতে দেখা যায়, যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এর ফলে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে বেশির ভাগ ঋণ। আর এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঋণই আদায় অযোগ্য মন্দ মানের খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। পুনর্গঠিত এসব ঋণ কেন মন্দ মানের খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে তার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ব্যাখ্যা তলবের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এসব ঋণ আদায়ে জোর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হবে। কোনো গ্রাহক ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা বাতিল করে দেয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওই সব ঋণ পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় কথা বলে ২০১৫ সালে বড় অঙ্কের ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনর্গঠনের নামে বিশেষ ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এর আওতায় ওই বছরে জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত এক নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। এ নীতিমালার আওতায় ৫০০ কোটি টাকা থেকে এক হাজার কোটি টাকার নিচের খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ এবং এক হাজার কোটি টাকার ওপরে মাত্র ১ শতাংশ ডাউন পোমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, তাদেরকে পুনরায় ব্যাংক থেকে যথারীতি নতুন করে ঋণ সুবিধাও দেয়া হয়। এ নীতিমালায় বলা হয়, এ সুবিধা নেয়ার প্রথম তিন বছর সংশ্লিষ্ট গ্রাহক কোনো নগদ লভ্যাংশ প্রদান করতে পারবেন না। সুদের হারেও বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। সুদের হার নির্ধারণ করা হয় ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সাথে অতিরিক্ত ১ শতাংশ। তাতে ওই সময়ের সুদহার বিদ্যমান সুদের হারের চেয়ে অনেক কমে যায়। এ সুবিধা নিতে ওই বছরের ৩০ জুনের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।

ওই নির্দেশনায় ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিদ্যমান সুদহার কমানো, ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ও কিস্তি পুনঃনির্ধারণসহ সব কিছু নতুন করে নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হয়। তবে এ জন্য গ্রাহককে আবেদন করতে হয় ব্যাংকে। আর ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ আবেদনের যৌক্তিকতা যাচাই করে অনুমোদনের জন্য পাঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। আবেদনের সাথে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ও নগদ অর্থের প্রবাহ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ‘এ’ ক্যাটাগরির চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম থেকে প্রত্যয়ন নিতে হয়। সার্বিক দিক যাচাই করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি এসব ঋণের অনুমোদন দেয়।

ব্যাংক ব্যবস্থায় ৫০০ কোটি টাকা বা তার অধিক ঋণ রয়েছে, এমন মেয়াদি গ্রাহক সর্বোচ্চ ১২ বছরের জন্য এবং নিয়মিত গ্রাহককে সর্বোচ্চ ছয় বছরের জন্য ঋণ পুনর্গঠন করার সুযোগ দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ সুবিধা পেতে প্রায় ১৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে। এর মধ্যে ১১টি শিল্প গ্রুপকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতিমালায় অনেক ফাঁকফোকর রাখা হয়। ওই নীতিমালার আওতায় একবারই কেবল ঋণ পুনর্গঠন করার সুযোগ দেয়া হয়। পুনর্গঠনের পর কোনো কারণে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ঋণ আদায়ে দেউলিয়া আদালতে মামলা করার সুযোগ রাখা হয়। প্রশ্ন উঠে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা নিয়ে। প্রচলিত নিয়মে টাকা আদায়ের জন্য প্রথমে অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে হয়। ওই মামলা নিষ্পত্তি হলে এতে ব্যাংকের পক্ষে রায় এলে তারপরে দেউলিয়া আদালতে মামলা করা যাবে। তবে ব্যাংকাররা ইচ্ছে করলে গ্রাহককে টাকা পরিশোধের নোটিশ দিয়ে সরাসরিও দেউলিয়া আদালতে মামলা করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে গ্রাহকের রাজনৈতিক প্রভাবের ওপর নির্ভর করবে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়াটি। পুনর্গঠনের নীতিমালার আওতায় সুবিধাভোগী গ্রাহক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। ফলে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার দায়ে গ্রাহকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ব্যাংকগুলোর দেয়া হয়নি। আর এ কারণেই দীর্ঘ দিন ধরে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়ে পরিশোধ না করলেও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী গ্রুপের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com