‘গ্যাসের দাম বাড়ালে অর্থনীতিতে ধস নামবে’
গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা অযৌক্তিক। তারা ভুল তথ্য তুলে ধরে এই প্রস্তাব দিয়েছে। কারণ গ্যাস কোম্পানিগুলো লোকসানে নেই। এখন হঠাৎ করে ভর্তুকি তুলে দাম বাড়ালে অর্থনীতিতে ধস নামবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম এসব কথা বলেন।
রোববার (২০ মার্চ) দুপুরে ধানমন্ডিতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) কার্যালয়ে ‘পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে?’ শীর্ষক ভার্চুয়ালি এক আলোচনা সভায় তিনি অংশ নেন।
এসময় ড. ম তামিম বলেন, ২১ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে যে গণশুনানি হবে, সেখানে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিক তথ্য দেয়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ১১৭ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে যতগুলো কোম্পানি আছে, তারা সবাই কিন্তু লাভ করছে। একটি কোম্পানিও নেই, যারা লোকসানে আছে। শুধু লোকসানের কোম্পানি হলো আরপিজিসিএল, যারা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে। পেট্রোবাংলা সবার কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে বিতরণ করছে, যে টাকাটা ঘাটতি থাকে সেটা দিতে হয় পেট্রোবাংলাকে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর যে উৎপাদন খরচ, সেখানে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমাদের দেশীয় উৎপাদন খরচে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজিতে এসেছে পরিবর্তন। সেখানে বেড়েছে দাম। কিন্তু ততোটা বেশি নয়। তেলের দাম যেখানে ছিল ৬০-৬৫ ডলার, সেখানে ৯০-৯৫ ডলারে গেছে। সেই সঙ্গে ১২ শতাংশ এলএনজির দাম। সেটা ধরে সেখানে কিছু বেড়েছে। সেই বৃদ্ধির দিকে যদি আমরা দেখি, তাহলে বলতে পারি গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হয়তো বাড়তে পারে। সেখানে কোম্পানিগুলোর ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর দাবি অযৌক্তিক।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম
জ্বালানি এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুটো ব্যাপারই রয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শুনানির মাধ্যমে ৫ শতাংশ কিংবা ১০ শতাংশ যতই মূল্যবৃদ্ধির পরামর্শ দিক, সরকার হয়তো না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু আমাদের জ্বালানির যে পুরো ব্যবস্থাপনা ও জ্বালানির যে প্রাথমিক ঘাটতি, সেটা কিন্তু যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এটা অনেক পুরোনো সমস্যা।
জ্বালানি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে দূরদর্শিতার অভাব ও সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় সংকট আরও প্রকট হচ্ছে বলে মত দেন ড. ম তামিম।
তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, মিস ম্যানেজমেন্ট হয়েছে। আমার পরামর্শ হবে হয়তো সামান্য কিছু মূল্যবৃদ্ধি করা যেতে পারে। এটা সইতে হবে আমাদের। কারণ, বাজারের দামের সঙ্গে আমাদের তেল-গ্যাসের মূল্য ও এর সার্বিক ব্যবস্থাকে সরকার কখনই সম্পৃক্ত করেনি। তাই এখন হঠাৎ করে ভর্তুকি তুলে দিয়ে দাম বাড়ালে অর্থনৈতিক ধস নামবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, জ্বালানির বর্তমান পরিস্থিতি বেশ অস্বাভাবিক। আমরা যদি ইতিহাস দেখি, তবে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে অর্থনৈতিক ধস নেমেছিল। তখন তেলের দাম ছুঁয়েছিল ১৪০ ডলার। এবারও ১৩৯ ডলারে গিয়ে ফিরে এসেছে। বর্তমানে যা ১০০ ডলারের নিচে। আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতেই পণ্যের দাম ওঠানামা করে। কিন্তু জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম দেখা যায়। সরবরাহ কমে যেতে পারে এই ভয়ে তেলের দাম ওঠানামা করে। যার বড় প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাই বাজারে।
ড. তামিম আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বলতে গেলে, বড় পুকুরিয়ার ২৫০ মেগাওয়াট ছাড়া পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের জ্বালানির যে ব্যবহার, তার পুরোটাই আমদানি করা কয়লা থেকে। তেলের কথাও বলতে গেলে শতভাগ আমদানি। আমরা পরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ডিজেল ব্যবহার করছি, এর পুরোটাই আমদানি করা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে ফার্নেস ওয়েল ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও মূলত আমদানি। সম্পূর্ণ কমার্শিয়াল জ্বালানির ৪০ শতাংশই আমদানি করছি আমরা।
দেশে ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা একসময় নিজস্ব সক্ষমতা থেকেই দীর্ঘদিন গ্যাস সরবরাহ করেছি, অথচ ২০১৮ সাল থেকে আমদানি করছি আমরা। বর্তমানে আমদানি করছি প্রায় ২৫ শতাংশ গ্যাস। তার ২০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে, যার পুরোটা তেলের দামের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৫ শতাংশ আমরা স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করছি। সেখানে সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে। এই মুহূর্তে সবার মনে যে প্রশ্ন ঘুরছে সেটি হলো- যদি তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী পরিস্থিতি হবে? অর্থনীতিতে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে ও মূল্যস্ফীতিতে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে। কিছুদিন আগে ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে করা হলো ৮০ টাকা, আমরা তার তাৎক্ষণিক ফল ও প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে দেখেছি।
সভায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, সিপিডির ফেলো মাহফুজুর রহমান, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।