রাশিয়ার পক্ষে না থাকা : যুক্তরাষ্ট্রের হুমকিতে ভয় পাবে চীন!
ইউক্রেনে হামলার ইস্যুতে তাদের চাপানো নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার কোপ রাশিয়ার ওপর কতটা পড়বে তার অনেকটাই যে চীনের ওপর নির্ভর করছে তা যুক্তরাষ্ট্র ভালো করেই জানে।
২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া দখলের পর রাশিয়ার ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞার ধার কমে গিয়েছিল চীনের কারণেই।
সে কারণেই যে এবার যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সরসারি হুমকি দেয়ার পথ নিয়েছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রধান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সালিভান।
ইটালির রাজধানী রোমে চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী কুটনীতিক ইয়াং জিয়েচির সাথে এক বৈঠকের আগে জেক সালিভান খোলাখুলি হুমকি দিয়েছেন নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে রাশিয়াকে সাহায্য দেয়ার চেষ্টা করলে চীনকে অবশ্যই পরিণতি ভোগ করতে হবে।
মার্কিন টিভি নেটওয়ার্ক সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বেইজিংয়ের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে আমরা বলেছি নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গার বড় কোনো প্রয়াস দেখা গেলে অবশ্যই তার পরিণতি ভোগ করতে হবে। আমাদের দেয়া নিষেধাজ্ঞা ভাঙার কোনো চেষ্টা বিশ্বের কোথাও আমরা সফল হতে দেব না।’
চীন ও রাশিয়ার দুই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার মধ্যে এই বৈঠক যেদিন হচ্ছে তার এক দিন আগে গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে আমেরিকান বিভিন্ন মিডিয়া খবর দিয়েছে যে রাশিয়া চীনের কাছ থেকে অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম চেয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, রোমের বৈঠকে চীনকে বলা হবে রাশিয়াকে যেন এই সাহায্য না পাঠানো হয়।
মার্কিন সূত্র উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে রাশিয়াকে সাহায্য করলে কী কী পরিণতি চীনকে ভোগ করতে হবে সোমবারের বৈঠকে তা স্পষ্ট করবেন জেক সালিভান।
সাংহাইতে বিবিসির সংবাদদাতা রবিন ব্রান্ট বলছেন রাশিয়া চীনের কাছে সাহায্য চাইছে এ কথা খোলাখুলি বলা আমেরিকার একটি কৌশল, যার উদ্দেশ্য চীনের ওপর চাপ তৈরি করা। ‘যাতে চীনকে হয় অস্বীকার করতে হয় অথবা স্বীকার করতে হয়।’
আমেরিকার হুমকিকে কতটা গুরুত্ব দেবে চীন?
গত দুই দশক ধরে চীন এবং রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্কে যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে তা নিয়ে ভিন্ন কোনো বিবেচনা কি প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং করবেন?
চীন এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে হামলার জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করেনি। একাধিকার বলেছে, নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার ‘উদ্বেগ বৈধ’ এবং তাকে বিবেচনায় নেয়া দরকার। নিরাপত্তা পরিষদে এবং পরে সাধারণ পরিষদের রাশিয়াকে নিন্দা করে নেয়া প্রস্তাবের পক্ষে তারা ভোট দেয়নি।
তবে অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক এখন বলছেন ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলায় ভেতরে ভেতরে চীন অস্বস্তিতে। কারণ, কোনো দেশের ভৌগলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকি না হওয়ার যে নীতি চীন অনুসরণ করে এই হামলা তার উল্টা। বিশেষ করে, রাশিয়ার হামলার ফলে ইউক্রেনে যে মানবিক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে তা নিয়ে চীন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। কারণ, এর পরও রাশিয়ার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখলে তাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের মধ্যে।
গবেষণা সংস্থা রোয়ি ইন্সটিটিউটের গবেষক রিচার্ড ম্যাকগ্রেগর ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলেছেন গত দু সপ্তাহে ধরে বেইজিংয়ের কাছ থেকে আসা শব্দ এবং বাক্যে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যায়, চীন খুব ধীরে মস্কোর কাছ থেকে একটি দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে ইউক্রেনের মানবিক পরিস্থিতি চীনকে অস্বস্তিতে ফেলছে।
কিন্তু একই সাথে তিনি বলেন, ‘বেইজিংয়ের মূল বার্তা যেটি- এই যুদ্ধের আসল দায় যে আমেরিকার তা এখনো অপরিবর্তিত।’
চীনা সরকারি মিডিয়ার দিকে চোখ দিলেই সেটি বোঝা যায়।
চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসাবে পরিচিত গ্লোবাল টাইমস প্রায় প্রতিদিনই ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কিত তাদের রিপোর্ট, মন্তব্য প্রতিবেদন বা সম্পাদকীয়তে ঘুরেফিরে এই সংকটের জন্য আমেরিকাকে দায়ী করছে।
পত্রিকাটি রোববার তাদের এক উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘মস্কো, কিয়েভ, প্যারিস এবং বার্লিন যেখানে দুই পক্ষকে মুখোমুখি বসানোর জন্য কূটনৈতিক চেষ্টা করে চলেছে, তখন সেখানে ওয়াশিংটন ক্রমাগত অস্ত্র জুগিয়ে চলেছে যাতে সংঘাত অব্যাহত থাকে।’
আমেরিকা ইউক্রেনকে কিভাবে অস্ত্র যোগাচ্ছে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সূত্রে তার একটি হিসাবও তুলে ধরা হয়েছে।
যেমন, শনিবার যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা দ্রুত অতিরিক্ত ২০ কোটি ডলারের ব্যবস্থা করছে যাতে হালকা অস্ত্র, ট্যাংক বিধ্বংসী এবং বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানো যায়।
জানুয়ারি ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ১২০ কোটি ডলারের সাহায্য দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দিয়েছে ৩২০ কোটি ডলার।
রাশিয়া অস্ত্র চেয়েছে বলে যে খবর আমেরিকাতে বেরিয়েছে তা অস্বীকার করেছে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একজন মুখপাত্র বলেছেন, আমেরিকা ইচ্ছা করে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
চীনা সরকারি মিডিয়ায় বলা হয়েছে, রাশিয়া এবং চীনের সম্পর্কে ভাঙনের চেষ্টা করছে আমেরিকা।
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে তা ধরে রাখতে চীন উদগ্রীব, কারণ এর পেছনে আবেগ বা অন্য কোনো কিছুর চাইতে রয়েছে বাস্তব স্বার্থ। চীনের জ্বালানি, খাদ্যশস্য এবং অস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ জোগানদার রাশিয়া।
এবং সবচেয়ে বড় কথা- বলছেন গবেষক রিচার্ড ম্যাকগ্রেগর- বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপ এবং এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খাটো করার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে দুই দেশেরই।
তিনি বলেন, তাছাড়া যদি কখনো তাইওয়ান প্রশ্নে রাশিয়ার সমর্থন দরকার হয়, সেটিও চীনের অন্যতম একটি বিবেচনা।
তবে শি জিন পিং স্পষ্টতই একটি ভারসাম্য রেখে চলার চেষ্টা করছেন। পুতিনের সরাসরি সমালোচনা তিনি হয়তো করছেন না, কিন্তু মানবিক দুরবস্থা লাঘবে ইউক্রেনে সাহায্য পাঠিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার নিন্দা করেছেন, কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েছেন চীনা কোম্পানিগুলো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে না।
বিমানের যন্ত্রাংশ বিক্রির রাশিয়ার এক অনুরোধ সম্প্রতি চীনা একটি কোম্পানি প্রত্যাখ্যান করেছে বলে রুশ মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর উদ্ধৃত করে খবর দিয়েছে রয়টার্স। রাশিয়া এখন ভারত ও তুরস্কের সাথে যোগাযোগ করছে বলে লেখা হয়েছে।
মার্কিন দৈনিক নিই ইয়র্ক টাইমসে সোমবারের এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে চীনা নেতারা এখন এই যুদ্ধ থেকে বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের স্বপ্ন দেখছেন। ‘তারা অঙ্ক করছেন যে দুটি পুরনো ক্লান্ত পরাশক্তির প্রতিপত্তি বিস্তারের এই সংঘাতের ঊর্ধ্বে চীনকে উঠতে হবে এবং দেখাতে হবে এই সংঘাত-পূর্ণ বিশ্বে তারাই স্থিতিশীলতার স্তম্ভ।’
শেনজেনভিত্তিক চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের অধ্যাপক ঝেং ইয়াংজিয়ানের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য চীনের মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বড় কোনো কৌশলগত ভুল না করি তাহলে চীনের আধুনিকায়নের যাত্রা ব্যাহত হবে না। বরঞ্চ, নতুন একটি বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে চীনের সক্ষমতা এবং ভূমিকা আরো বৃদ্ধি পাবে।’
সূত্র : বিবিসি