ইউক্রেন যুদ্ধ ও পুতিন-বাইডেনের লাভ ক্ষতি
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান যত দ্রুত শেষ করার প্রত্যাশা প্রেসিডেন্ট পুতিন যেভাবে করেছিলেন সেভাবে সম্ভবত হচ্ছে না। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যেখানে দেশটির ওপর রুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করা হয়েছিল সেখানে যুদ্ধের দ্বাদশ দিনেও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না ক্রেমলিন আদৌ ইউক্রেনের ওপর সামরিক বিজয় পাবে কিনা। আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থোনি ব্লিংকেন তো বলেছেন, এই যুদ্ধে ইউক্রেন বিজয়ীও হতে পারে।
দু’সপ্তাহে আগে ব্লিংকেনের এ কথা একেবারে হাস্যকর বলে মনে হলেও এখন অনেকে এর মধ্যে বাস্তবতার কিছু উপকরণ খুঁজে পেতে পারেন। এ পর্যন্ত রাশিয়া খুব স্বল্পসংখ্যক শহরই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। আবার একাধিক শহর ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ দখলমুক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে। ইউক্রেনের সশস্ত্রবাহিনী ও জনগণ যেভাবে রাশিয়ান হামলাকে তাদের স্বাধীনতার ওপর আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করে জীবন বাজি রেখে প্রতিরোধ শুরু করেছে সে রকম মস্কো ও তার মিত্ররা আশা করতে পারেনি বলে মনে হচ্ছে।
একই সাথে রাশিয়ার এই ইউক্রেন অভিযান পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যে বিভাজন ও সংশয় ছিল তা দূর করে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়ার অবস্থায় নিয়ে গেছে তাও রাশিয়ান নেতাদের হিসাবের মধ্যে ছিল না। ফলে এক নজিরবিহীন অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়েছে রাশিয়া। এমনকি রাশিয়ার কৌশলগত ও কাছের মিত্র দেশগুলোও এক ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে। যার ফলে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের নিন্দা জানানোর জন্য জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে আনা প্রস্তাবে কেবলমাত্র রাশিয়া ছাড়া অন্য চারটি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। চীন-ইরানের মতো কৌশলগত মিত্র দেশও এ ভোটাভুটিতে রাশিয়াকে সমর্থন না করে ভোটদানে বিরত থেকেছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, পশ্চিমা দেশগুলোর রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পর চীন রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক ও নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক রাশিয়া ও বেলারুশের সাথে সব ধরনের লেনদেন স্থগিত রাখার কথা জানিয়েছে। সুইফট এবং ডলার ইউরোর মতো বৈশ্বিক মুদ্রা লেনদেন ও রিজার্ভ সংরক্ষণে বিধিনিষেধের পর নিজেদের প্রতিষ্ঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন লেনদেন বন্ধের ঘোষণা দেয় তখন পরিস্থিতি যে রাশিয়ার জন্য কতটা গুরুতর সেটি অনুমান করা যায়।
ভ্লাদিমির পুতিন শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের সাথে আলোচনা করেই ইউক্রেনের অভিযানে নেমেছেন বলে ধারণা করা হয়। অলিম্পিক শেষ হবার একদিন পরেই ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করা থেকেই স্পষ্ট হয় যে বেইজিং রাশিয়ার এ পদক্ষেপের পেছনে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু আক্রমণ পরবর্তী সময় রুশ হামলাকে সর্বতোভাবে সমর্থন না করে দূরত্ব রেখে পক্ষে থাকার বিষয়টি বেইজিংয়ের বৈশ্বিক বাস্তবতা উপলব্ধির প্রমাণ বলে মনে হয়। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধের সিদ্ধান্ত অনিবার্য বাস্তবতার অংশ বলেই মনে হয়। এমনকি চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছা করলেই রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক লেনদেন অব্যাহত রাখতে পারবে না এ কারণে যে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অধীন প্রতিষ্ঠানের সাথে যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লেনদেন করবে সেসব প্রতিষ্ঠানও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। আর রাশিয়ান অর্থনীতির চেয়েও চীনা অর্থনীতি বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
সম্ভবত এ কারণেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্কটে মধ্যস্থতা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার জোরালো উদ্যোগ তুরস্ক ও ইসরাইলও নিয়েছে বলে মনে হয়। এ ছাড়া পুতিনের সাথে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর শোলজও নিয়মিতভাবে কথা বলছেন। কিন্তু চীনের মধ্যস্থতা অন্য যে কোনো উদ্যোগের তুলনায় অধিক কার্যকর হবে এ কারণে যে, পশ্চিমা বলয়ের বিচ্ছিন্নতার মুখে রাশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য বেইজিংয়ের সমর্থনের বিকল্প নেই। আর চীনের এই ইঙ্গিতের পেছনে ক্রেমলিনের প্রচ্ছন্ন সম্মতি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
প্রশ্ন হলো, রাশিয়া কেন ইউক্রেন দখলের জন্য এই আক্রমণ করল আর সেই লক্ষ্য পুতিন কতটা অর্জন করতে পেরেছেন। ইউক্রেন আক্রমণের পূর্ববর্তী পুতিনের ঘণ্টাব্যাপী তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণটি অনুধাবনের চেষ্টা করলে কয়েকটি বিষয় সহজ হবে। প্রথমত, পুতিন রাশিয়াকে বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতাধর হিসেবে বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানে নিয়ে যেতে চান। এ জন্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৪টি প্রজাতন্ত্রকে রাশিয়ার একীভূত করা হয়তো সম্ভব হবে না, তবে এসব প্রজাতন্ত্রকে রুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে পুতিনের সামনে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তিনি জর্জিয়া ও বেলারুশে হস্তক্ষেপ করেছেন। মধ্য এশিয়ার আজারবাইজান ও সর্বশেষ কাজাখস্তানে হস্তক্ষেপ করেছেন। এসব হস্তক্ষেপে তিনি যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তাতে তিনি সফল বলেই মনে হয়। রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতন্ত্র ছিল ইউক্রেন। ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ উপদ্বীপ ক্রাইমিয়া দখল করে সেটিকে রাশিয়ার সাথে অঙ্গীভূত করেছেন পুতিন। সেই সাথে ডনবাসের রুশভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলকে প্রক্সি দিয়ে দখলে নিয়েছেন।
কিন্তু এত কিছুর পরও রুশপন্থী সরকারের পতনের পর পুতিন ইউক্রেনকে হুমকি হিসেবে দেখে আসছিলেন কয়েকটি কারণে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে ইউক্রেন। ন্যাটোর সদস্য হলে এই সংস্থার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইউক্রেন পর্যন্ত বিস্তৃত হবে আর সে ক্ষেত্রে ক্রেমলিন চাইলেই ইউক্রেনে হামলা করতে পারবে না। সেটি করার অর্থ হবে পুতিন যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বারবার বলছেন সেটি বাস্তবে ঘটে যাওয়া। এ জন্য তিনি ট্রিগারের সামনে ইউক্রেনে অবস্থান পরিবর্তন অথবা মস্কোর দাবি পূরণে বাধ্য করার অবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মৌলিকভাবে পুতিন দুটি বা তিনটি দাবি ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য শর্ত করে দিয়েছেন। সেগুলো সামনে আনা হলে এর কিছুটা তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে।
যুদ্ধ শুরু করার আগে পুতিনের দাবি ছিল ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি, যার মধ্যে প্রথমেই ছিল ইউক্রেনে বা পূর্বমুখী ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার গ্যারান্টি দেয়া। দ্বিতীয়ত, ১৯৯৭ সালের পর ন্যাটোর যে সম্প্রসারণ হয়েছে সেটিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া অর্থাৎ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ও পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশকে ন্যাটো সদস্য করা হয়েছে তাদের পরিত্যাগ করা। তৃতীয়ত, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনকে সদস্য না করা। ন্যাটো বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই রাশিয়ান দাবির প্রতি নমনীয়তা দেখায়নি। বরং তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে।
তবে একই সাথে ইউক্রেনকে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদও দেয়া হয়নি। পশ্চিমা নেতারা ইউক্রেনে সামরিকভাবে যুক্ত না হওয়ার ঘোষণাও বারবার দিয়েছেন। যদিও ইউক্রেনকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা দেয়া ও আগ্রাসনের প্রতিবাদে সামরিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়ে এসেছে পশ্চিমা দেশগুলো। যুদ্ধ বন্ধের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সেই হুমকি পশ্চিমারা বাস্তবায়নও করেছেন। আর এটি এমনভাবে হয়েছে যে এমন মাত্রার অবরোধ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের প্রত্যাশা রাশিয়া করেনি। এক দিকে ধারণার চেয়ে অনেক ব্যাপক মাত্রায় ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ, অন্য দিকে অনেক গভীর আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে।
কেন বা কিভাবে এটি হলো তা বুঝতে হলে রাশিয়ান ক্ষমতার উৎস ও রহস্যটা জানতে হবে। এর মধ্যে এক দিকে রয়েছে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা আর অন্য দিকে রয়েছে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা স্বার্থ। তুরস্ক থেকে শুরু করে আমেরিকার আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহত্তম ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে রাশিয়া গঠিত হলেও এর জনসংখ্যা ১৭ কোটির নিচে। এর অর্থনীতি প্রধানত জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ার রফতানি আয়ের ৬০ ভাগ, বাজেটের ৪০ ভাগ এবং স্থূল দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২০ ভাগ আসে জ্বালানি খাত থেকে। বাকি আয়ের বড় অংশ প্রতিরক্ষা শিল্প এবং কিছু আয় গম, ভুট্টার মতো কৃষি খাতের পণ্য থেকে আসে।
আয়ের এই ক্ষেত্রগুলো হলো রুশ ক্ষমতার প্রধান ভিত্তি। জ্বালানি আয়ের টেকসই অবস্থার জন্য প্রয়োজন বাজার, আর প্রতিরক্ষা আয় অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক প্রভাব। আর এ দুটির সমন্বিত প্রয়োজনে নিরাপত্তা চাহিদা পূরণ করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন পুতিন। রাশিয়ান জ্বালানির গতানুগতিক বাজার হলো ইউরোপ। ইউরোপে গ্যাস রফতানির প্রধান রুট বা পাইপলাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া ও ডনবাস এলাকা দখলের ক্রদ্ধতার জন্য রুশ অবান্ধব সরকার যেকোনো সময় মস্কোর জন্য বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। যার কারণে ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনেকটা বেপরোয়া ও মূল্যদায়ক পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননি ভøাদিমির পুতিন। এমনকি তিনি লক্ষ্য অর্জনের জন্য পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকিও দিয়েছেন। বলেছেন, যে গ্রহে রাশিয়ার গুরুত্ব থাকবে না সেই পৃথিবীর থাকার দরকার কী? আর ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বজায় রাখার অধিকারের বিষয়টিই তিনি অস্বীকার করেছেন।
যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পুতিন যে শর্তগুলো দিচ্ছেন তা খুবই কর্কশ শোনায়। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র সমর্পণ করে সামরিক ক্ষমতাবিহীন হতে হবে। কোনো জোটে অংশ না হওয়ার অঙ্গীকার করতে হবে। ক্রিমিয়া ও ডনবাস অঞ্চলকে রুশ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ইউক্রেনের ‘নাৎসি সরকার’ অর্থাৎ ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। পুতিনের এসব শর্ত দৃশ্যত কোনোভাবেই সমঝোতায় আসার মতো নয়।
অবশ্য পুতিন যে ধরনের শর্তের কথা মুখে বলুন না কেন ইউক্রেনকে সামরিকভাবে পুরো জয় করতে না পারলে এসব শর্ত কোনোভাবেই তিনি আদায় করতে পারবেন বলে আশা করা যায় না। আর রাশিয়া দু’সপ্তাহের যুদ্ধ সময়ে যে অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে তাতে এমন কিছু দিক হাজির হয়েছে যা রাশিয়ার জন্য সুখকর নয়। ইউক্রেনের দাবি অনুসারে ১২ দিনের যুদ্ধে প্রতিদিন গড়ে ১০০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় কমান্ডারও রয়েছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জঙ্গিবিমান ও হেলিকপ্টার আর ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ইউক্রেনের দাবি অনুসারে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি অতোটা না হলেও রাশিয়া যে বড় ধরনের সামরিক ক্ষতির মুখে পড়েছে সেটি উপলব্ধি করা যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই শীর্ষ দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স ভিন্ন অবস্থান গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন। দুই সরকারপ্রধান আলাদা আলাদাভাবে রাশিয়া সফর করে পুতিনের সাথে দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন। তারা প্রথম দিকে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা না পাঠানোর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার বাস্তব সামরিক আক্রমণের পর পুরো দৃশ্যটা পাল্টে গেছে। ন্যাটো বা পশ্চিমা বলয়ের মধ্যে অকাস ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল সেই ফাটল যুদ্ধের পর আর থাকেনি।
রুশ-জার্মান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত নর্থ স্টিম-২ পাইপলাইন প্রকল্পের অনুমোদন জার্মানি স্থগিত করেছে এবং ইউক্রেনে বার্লিন সামরিক সহায়তা পাঠাতে শুরু করেছে। একই ধরনের পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও। ইউরোপের সব দেশই রুশ আক্রমণে নিরাপত্তা শঙ্কা বিরাজ করতে শুরু করেছে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের আলোচনা শুরু করেছে। অবরোধে যোগ দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের মতো দেশও। জার্মানি প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করেছে। ইউরোপের ছোট বড় প্রতিটি দেশ নিরাপত্তা উদ্যোগ ও বাজেট বাড়িয়েছে। রাশিয়ার জন্য শঙ্কার বিষয় হলো ইউরোপ রাশিয়ার বিকল্প জ্বালানি উৎসের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে।
রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান যত দীর্ঘস্থায়ী হবে পরিস্থিতির মেরুকরণ তত বেশি ধারালো হবে। আর ন্যাটো ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি না জড়ালেও দেশটির প্রতিরোধে যে তাদের সক্রিয় সমর্থন রয়েছে তা এখন আর অস্পষ্ট নয়। ফলে দ্রুত ইউক্রেনের পতন ঘটবে বলে মনে হয় না। আর পুতিনের অব্যাহতভাবে পারমাণবিক ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি উচ্চারণ তার যুদ্ধবাজ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতার ইমেজ তৈরি করছে। এই ইমেজ আর্কটিক অঞ্চলে জ্বালানি সম্পদ আহরণ ও তা বিক্রি করে রাশিয়ার সামনে যে অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল সেটিও নষ্ট করতে পারে। একই সাথে রাশিয়ার অভ্যন্তরে এবং বেলারুশের মতো মিত্র দেশগুলোতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে পারে। পশ্চিমারা এজন্য তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বলে নানা ঘটনায় মনে হচ্ছে।
সার্বিকভাবে জর্জিয়া, বেলারুশ, ক্রাইমিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, চেচনিয়া এবং দেশের বাইরে সিরিয়া, লিবিয়ার রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামরিক হস্তক্ষেপ যে অর্জন করেছে সেটি নবপর্যায়ে ইউক্রেন অভিযানে অর্জন করতে পারছে বলে মনে হয় না। অধিকন্তু সার্বিক লাভ-ক্ষতিকে গাণিতিকভাবে টেবিলে সাজানো হলে পুতিন বা রাশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী কোনো দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত এ কারণে অনমনীয় পুতিনকে এখন কিছুটা নমনীয় মনে হচ্ছে বেলারুশকেন্দ্রিক ইউক্রেন-রাশিয়া আলোচনায়। এতে কিছুটা অগ্রগতি হতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তুরস্কের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আনাতোলিয়ায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে হাজির হচ্ছে মস্কো-কিয়েভ। চীন সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ার ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে।
এসব উদ্যোগে এখনই ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটবে অথবা সঙ্কট উত্তরণ হবে কিনা তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে দুই সপ্তাহের যুদ্ধে বিশ্বব্যবস্থায় যে ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমরা আগামীতে নতুন এক পৃথিবী বা বিশ্বব্যবস্থা দেখতে পাবো বলে মনে হয়। চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে বিকল্প আন্তর্জাতিক লেনদেন ও আর্থিক ব্যবস্থা তৈরির জন্য যে কাজ শুরু হয়েছিল সেটি পরিপক্ব হওয়ার আগেই পশ্চিমা বলয় থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে পাল্টা আঘাত এসেছে রুশ অক্ষের ওপর। এই আঘাতের ফলে হয়তোবা বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ দ্রুততা পেতে পারে। অথবা এই উদ্যোগ বেশ কিছু সময়ের জন্য স্থবির হয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধে জয়ের চেয়েও চলমান লড়াইটিকে ‘গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদের লড়াই’ হিসেবে চিহ্নিত করে যে প্রচার বাইডেন শুরু করেছিলেন তাতে পশ্চিমারা মোটা দাগে একই বিন্দুতে চলে এসেছে। এ সময়ে এটিকে বাইডেনের সাফল্য আর পুতিনের দাপটে চলার পথে ব্যত্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।