ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আটকে পড়ে কূটনৈতিক দ্বিধায় ভুগছে ভারত
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যখন ২৫ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি ভোটদানের প্রস্তাব আনে , তখন তিনটি দেশ সেই ভোটদান থেকে বিরত ছিল । মস্কোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে চীন ভোটদানে বিরত ছিল । সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ভারতও ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতি বিশ্লেষক বলেছেন, ” এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল যে ভারত যদি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থাকতো তাহলে সংযুক্ত আরব আমিরাতও ঠিক তাই করতো । ভারত আসলে “সুইং স্টেট”। কিন্তু ২ মার্চ, যখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ একই প্রস্তাবের উপর ভোটদানের আয়োজন করে তখন সংযুক্ত আরব আমিরাত এটির পক্ষে ভোট দেয়। ভারত আবারও বিরত থাকল। রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক ১৯৭১ সাল থেকে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের সাথে তার যুদ্ধে ভারতকে সমর্থন করেছিল।ভারত ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আক্রমণ, বা ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া, এমনকি ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে একটিও কথা বলেনি।তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চীনের হুমকি বৃদ্ধি ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে।
তবুও, ভারতীয় নেতৃত্ব রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার বা সম্পূর্ণরূপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে চায়নি।তবুও ওয়াশিংটনে কেউ কেউ হয়তো অবাক হয়েছেন যে ভারত জাতিসংঘের প্রস্তাব থেকে বিরত ছিল। বাইডেন প্রশাসন চীনকে মোকাবেলা করার জন্য ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার আকাঙ্ক্ষা গোপন করেনি। বিশেষ করে যখন চীনের সাথে ভারতের নিজস্ব সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। মস্কো, জাতিসংঘে ভারতের অবস্থানের জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। ভারতে রাশিয়ান দূতাবাস নিরাপত্তা পরিষদের ভোটের পরে টুইট করে বলেছে : “ভারতের স্বাধীন এবং ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের জন্য আমরা উচ্চ প্রশংসা করি।”
ভারতীয় সামরিক সরঞ্জামের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ এবং সামরিক পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক খুচরা যন্ত্রাংশ রাশিয়া থেকে আসে।
রাশিয়ান সামরিক সরঞ্জামের উপর নির্ভরতা ছাড়াও, ভারত শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল হতে চায় না। সেটাও হয়তো তার ভোটদান থেকে বিরত থাকার কারণ, বলেছেন সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজির পরিচালক রাজেশ্বরী পিল্লাই রাজাগোপালান । ভারতে অনেকেই ইউক্রেনের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সেখানকার হাজার হাজার ভারতীয় ছাত্রদের জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। রাশিয়ার দাবি , ইউক্রেনীয়রা ভারতীয় পড়ুয়াদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তবুও ভারতের কিছু মানুষ বিশেষত যারা ডানপন্থী তারা ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি সহানুভূতিশীল।ব্র্যান্ড নিউ নেশনের লেখক রবিন্দর কৌর বলেছেন, যারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বারা উত্সাহিত ভারতে অতি জাতীয়তাবাদী তরঙ্গে গা ভাসাচ্ছেন তারা রাশিয়ান রাষ্ট্রপতিকে একজন নায়ক মনে করেন। মেকিং ইন্ডিয়া গ্রেট-এর লেখক অপর্ণা পান্ডের মতে ,”ডানপন্থীদের কেউ কেউ পুতিনের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পুনরুদ্ধার এবং তাদের নিজস্ব হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার মধ্যে সামঞ্জস্য দেখতে পান। ”
রাজাগোপালন বিশ্বাস করেন যে ভারতের সিদ্ধান্ত বর্তমান রাজনীতির চেয়ে ইতিহাসের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তাঁর মতে , দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ অংশীদারিত্বের কারণে ভারত রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও রাশিয়ার আক্রমণের পক্ষে কোনও সমর্থন জানায়নি ভারত । আগামীদিনগুলিতে প্রকাশ্যে রুশ-বিরোধী অবস্থান না নিয়ে ভারত মধ্যম অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করবে। যদিও এটি খুবই কঠিন কাজ। ভারত কতদিন এই অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হবে তা স্পষ্ট নয়। আপাতত, ওয়াশিংটন বিষয়টি ভালোমতোই বুঝতে পারছে। অপর্ণা পান্ডের মতে , চীনের হুমকি ঠেকাতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের জন্য আমেরিকার ভারতকে প্রয়োজন। তাই চড়াই উৎরাই থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত একসাথে কাজ চালিয়ে যাবে। এটি ঠিক যে কেউ এখনও জানে না, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা ভারতের জন্য কী অর্থ বহন করবে। রাশিয়ান S-400 মিসাইল সিস্টেম কেনার জন্য ভারতের পক্ষে নিষেধাজ্ঞায় ছাড় পাওয়া আরও কঠিন হতে পারে। এমন খবর পাওয়া গেছে যে নিষেধাজ্ঞার জেরে উদ্ভুত অর্থনৈতিক ধাক্কার মোকাবিলা করার জন্য ভারত একটি রুপি-রুবল বাণিজ্য ব্যবস্থা অন্বেষণ করতে পারে। (যদিও এমন রিপোর্টও পাওয়া গেছে যে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া নিষেধাজ্ঞার অধীনে যে কোনও রাশিয়ান সংস্থার সাথে জড়িত লেনদেন বন্ধ করতে প্রস্তুত)। এটাও সত্য যে এই যুদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার হিসেব বদলে দেবে। ৩ মার্চ, একটি ভিডিও কলের আগে, ভারত বলেছিল যে কোয়াড দেশগুলি – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া – ইন্দো-প্যাসিফিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবে, কিন্তু মার্কিন পক্ষ ঘোষণা করেছিল যে তারা ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। যদিও বিশ্লেষকরা একটি বিষয়ে সহমত যে ,ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের জন্য এজেন্ডায় আরও অনেক আইটেম রয়েছে। ওয়াশিংটন দিল্লির একমাত্র উদ্বেগ নয় ।