পুতিনকে কেন ডিএনএ দিতে চান না বিশ্বনেতারা?
জ্ঞান যদি শক্তি হয় তাহলে একজনের ডিএনএ’র মতো চরম গোপন তথ্য জানা হতে পারে শক্তিশালী অস্ত্র। এ থেকেই হয়তো সম্প্রতি মস্কো সফর করা বিশ্বনেতাদের রাশিয়া পরিচালিত করোনাভাইরাস পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সক্ষমতার চেয়ে কল্পনাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি মস্কো সফরে গিয়ে ফ্রান্স ও জার্মানির নেতারা রাশিয়ায় করোনাভাইরাস পরীক্ষা করেননি। এমন খবর প্রকাশের পর জল্পনা শুরু হয়েছে, ডিএনএ তথ্য রাশিয়াকে না দিতে তারা এমনটি করেছেন। তারা চাননি পুতিনের হাতে এই গোপন তথ্য চলে যাক।
জিনবিজ্ঞান হয়তো একদিন অস্ত্রের তালিকায় যোগ হতে পারে বলে মনে করেন গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেদিন হয়তো এখনও অনেক দূরে।
ফ্রান্স ও জার্মানি কেন রাশিয়াকে অবিশ্বাস করছে?
দুই দেশই ন্যাটো সদস্য। এই জোটে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনও। শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েতবিরোধী পশ্চিমা মিত্ররা গঠন করে ন্যাটো জোট। ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করে শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ইউরোপের নিরাপত্তা অবকাঠামো সংস্কারের আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে রাশিয়া। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা আশঙ্কা করছে, রাশিয়া ইউক্রেনে যেকোনও সময় হামলা চালাতে পারে। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মস্কো সফর করেন ফ্রান্স ও জার্মানির নেতা।
তবে সফরকারী দুটি দেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডিএনএ তথ্য চুরির চেষ্টার অভিযোগ করা হয়নি। তারা দাবি করেছেন, নিজ দেশের প্রটোকল মানতে গিয়ে তারা রাশিয়ায় করোনাভাইরাস পরীক্ষা করেনি। এমনকি ফ্রান্সের পক্ষ থেকে ডিএনএ’র তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে ব্যাপক জল্পনা থামেনি।
যুক্তরাষ্ট্র কি বিশ্বনেতাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে?
বিদেশি অতিথিরা যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর দরকার হয়। হোয়াইট হাউজেই পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ নেতাদের নিজস্ব পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকে, যা মেনে নেয় হোয়াইট হাউজ।
নিজ দেশ বা বিদেশে যখন বাইডেনের নিজের পরীক্ষা করা হয় তখন নমুনা সংগ্রহ থেকে যাবতীয় প্রক্রিয়া তদারকি করে হোয়াইট হাউজের মেডিক্যাল ইউনিট।
মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধেও রয়েছে বিদেশি নেতাদের ডিএনএ সংগ্রহের অভিযোগ। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া ওবামা আমলের গোপন কূটনৈতিক নথি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মার্কিন কূটনীতিকরা কয়েকটি আফ্রিকান দেশের উদীয়মান ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ, মুখের ছবি, ডিএনএ এবং চোখের আইরিশ স্ক্যান সংগ্রহ করেছেন।
ডিএনএ থেকে কী জানা যায়?
শরীরের প্রতিটি কোষেই ডিএনএ থাকে। আর এটি একাধিক প্রক্রিয়ায় বের করা যায়। নাকের সর্দির নমুনা থেকেও এটি নেওয়া যায়। যদিও করোনা পরীক্ষায় ভিন্ন আরেকটি জেনেটিক উপকরণ ব্যবহার হয়: আরএনএ।
ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার জেনোমিক সেন্টারের পরিচালক কেনি বেকম্যান বলেন, ‘এসব নমুনায় মানুষের বহু ডিএনএ থাকে। আপনি নিশ্চিতভাবেই এসব নমুনা নিয়ে ডিএনএ বের করতে পারেন এবং সেটি কাজে লাগানোর সুযোগ আছে।’
মানুষের বেঁচে থাকতে ও বেড়ে উঠতে যেসব নির্দেশনার প্রয়োজন হয় তা ডিএনএ-তে থাকে। প্রত্যেক মানুষের ডিএনএ অনন্য। পূর্ব পুরুষেরা কোন জায়গা থেকে এসেছেন, অজ্ঞাত কোনও স্বজন আছে কিনা তা খুঁজতেও ডিএনএ ব্যবহার করা যায়। আবার নির্দিষ্ট কোনও জেনেটিক রোগ কিংবা অস্বাভাবিকতা রয়েছে কিনা তাও দেখা যায়। ফরেনসিক বিজ্ঞানে কোনও অপরাধে সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে ডিএনএ ব্যবহার করা হয়।
বিশ্বনেতাদের বিরুদ্ধে ডিএনএ তথ্য কাজে লাগানো যায়?
‘কোনও রোগের ঝুঁকি শনাক্ত করতে ডিএনএ ব্যবহার করা যায়, ফলে বিশ্বনেতারা কোনও রোগের ঝুঁকিতে থাকলে তা জানা যেতে পারে,’ বলেন হাওয়ার্ড ম্যাকলিউড। ফ্লোরিডাভিত্তিক জেরিয়াট্রিক অনকোলোজি কনসোর্টিয়ামের জেনেটিক বিশেষজ্ঞ ও পরিচালক ম্যাকলিউড বলেন, ‘ডিএনএ থেকে ফাঁস করার মতো পূর্বসূরি সংক্রান্ত কোনও তথ্য থাকলে তা পাওয়া যেতে পারে।’
তিনি জানান, তবে সাধারণভাবে বিশ্বনেতাদের মতো কারও সম্পর্কে ডিএনএ থেকে তথ্য জানা ‘বাস্তবতার চেয়ে বেশি ভয়ংকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কেনি বেকম্যান মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে ক্ষতি করতে ডিএনএ থেকে তথ্য সংগ্রহ করার চিন্তা এখনও কল্পনাতীত। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি জানতে পারেন ম্যাক্রোঁর রক্তচাপের ঝুঁকি কিছু বেশি, তাহলে কী করতে পারবেন? এর ফলে কারও জিনগত তথ্যকে অস্ত্রে পরিণত করার কল্পনায় আমি বেশি সময় ব্যয় করতে চাই না।’
জিনগত গোপনীয়তা নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি করেছেন বায়োঅ্যাথিসিস্ট জর্জ অ্যানাস। তিনি একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাইলেন, ‘ডিএনএ কোনও ম্যাজিক নয়। এটা আপনাকে কিছু তথ্য দেবে, কিন্তু এ থেকে আপনি জানতে পারবেন না, কীভাবে কাউকে খুন করা যেতে পারে।’
ডিএনএ তথ্য দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে লক্ষ্য করে জৈবঅস্ত্র বানানোর সক্ষমতা এখনও নেই। কিন্তু এমন কিছু করার ধারণাই বিশ্বনেতাদের সতর্ক হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর কারও জন্য বিব্রতকর তথ্য প্রকাশের হুমকি দিয়ে জিম্মি করার ইতিহাস রাশিয়ার রয়েছে। পশ্চিমাদের সতর্কতা অবলম্বনের নেপথ্যে এটিও কাজ করে থাকতে পারে।
বিশ্বনেতাদের ভীত হওয়ার কিছু আছে কী?
এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ঐকমত্য যেটাতে রয়েছে তা হলো, কোনও অসাধু ব্যক্তি ডিএনএ দিয়ে কেলেঙ্কারি তৈরি করতে পারে। কিন্তু কোনও প্রেসিডেন্টের ক্লোন বানানো সম্ভব নয়।
যদিও ডিএনএ তথ্য কোথায় গিয়ে থামবে তা হয়তো অজানা থাকবে। কয়েক বছর আগে নিজেদের আর্নেস্ট প্রজেক্ট দাবি করা একটি অজ্ঞাত গ্রুপ দাবি করেছিল, তারা দাভোস সম্মেলনে অংশগ্রহণ করা বিশ্বনেতাদের একটি অংশের ডিএনএ তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে। গ্রুপটি দাবি করে, পুঁজিবাদী নজরদারির বিপদের নজির হিসেবে তারা এসব নমুনা নিলামে তুলবে। তবে আইনি জটিলতায় ওই নিলাম বিলম্বিত হয়। আর কখনও নিলামের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি।