রাশিয়া-চীন ঐক্য নিয়ে চিন্তায় ভারত!
ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার ঐক্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা চলছে। এই ঐক্য নিয়ে কী ভাবছে ভারত। ভারতের মূল্যায়নের বিশেষ গুরুত্ব থাকার কারণ হলো দেশটি চীনের সাথে বৈরিতায় থাকলেও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করছে। দেশটি থেকে অস্ত্রও ক্রয় করছে। এই প্রেক্ষাপটে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এখানে তুলে ধরা হলো
পঞ্চাশ পাতার যৌথ নথি প্রকাশ করে রাশিয়া ও চীন ঐক্যের যে ছবিটা তুলে ধরেছে, এই মুহূর্তে যা আন্তর্জাতিক রাজনীতি তোলপাড় করছে— তার স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় রয়েছে নয়াদিল্লির। ভারতের পররাষ্ট্র দফতর সূত্রের মতে, পরিস্থিতির দিকে ভারত নজর রাখছে ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে এখনই শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। কারণ ইতিহাস বলছে, চীন-রাশিয়ার সম্পর্কের ভিতর বরাবরই মৌলিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব রয়েছে। উভয়ের কূটনৈতিক মতাদর্শ এবং লক্ষ্যও এতটাই আলাদা যে, তারা যৌথভাবে এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারতের উপরে কোনো কৌশলগত চাপ তৈরি করতে পারবে না।
গত সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন করমর্দন করে জানিয়েছেন, আমেরিকার একনায়ক-সুলভ আচরণের বিরুদ্ধে তারা একজোট। যৌথ বিবৃতির বক্তব্য, ‘আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো আঘাত এলে বা বাইরে থেকে কেউ নাক গলালে রাশিয়া এবং চীন পরস্পরের পাশে দাঁড়াবে।’
সাউথ ব্লকের বক্তব্য, এই মৈত্রী খুবই ভঙ্গুর। চীনের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক কখনই মধুর ছিল না। গোটা ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে উভয়ের মধ্যে আস্থার অভাব প্রকট ভাবে দেখা গিয়েছে। ১৯৫৮ সাল থেকে ৩১ বছর কোনো সোভিয়েত নেতাকেই চীন সফরে যেতে দেখা যায়নি। ১৯৮৯ সালে যান রাশিয়ায় মিখাইল গর্বাচেভ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা ওঠাপড়া চলে। অবশেষে ২০০১-এ পুতিন রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী সম্পর্ক বজায় রাখতে চুক্তি হয়। তবে সেই থেকে আজ পর্যন্ত চীন-রাশিয়া জোট কখনোই কোনো আনুষ্ঠানিক কৌশলগত জোটের চেহারা পায়নি। দু’টি রাষ্ট্রের মতাদর্শও ভিন্ন থেকেছে।
২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের সময় জাতিসঙ্ঘের গণভোটে চীন অনুপস্থিত থাকে। গত সপ্তাহের যৌথ বিবৃতিতেও রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের কোনো স্বীকৃতি দেয়নি চনি। পাশাপাশি, ইউক্রেন নিয়ে চলতি সংঘাতেরও কোনো উল্লেখ নেই রুশ-চীন যৌথ বিবৃতিতে। নিরাপত্তার প্রশ্নে চীনের পাখির চোখ এশিয়া। রাশিয়ার ইউরোপ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়ার গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এখন চীনের এক দশমাংশ মাত্র। কিন্তু চীনের ছোট-ভাই হয়ে থাকতে কোনো ভাবেই প্রস্তুত নয় মস্কো। রাশিয়া এটাও খতিয়ে দেখেছে, চীনকে বিক্রি করার চেয়ে জার্মানি এবং ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস রফতানি করা অনেক বেশি লাভজনক। তা ছাড়া মধ্য এশিয়ায় চীন-রাশিয়া সহযোগিতা নিয়ে যত কথাই হোক না কেন, রাশিয়া এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব কমতে দিতে আদৌ রাজি নয়।
ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়েও চীন এবং রাশিয়ার মতভেদ রয়েছে। চীনের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। তুলনায় রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য অনেকটাই কম। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের যুদ্ধ বাধলে চীনের পক্ষে রাশিয়াকে সমর্থন করা কঠিন। অন্য দিকে ইউক্রেন চীনের মহাযোগাযোগ প্রকল্প ওবর-এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। চীনের সাথে ইউক্রেনের বাণিজ্যও ক্রমবর্ধমান।
আরো একটি বিষয়কে ভারত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। রাশিয়া-চীন বিবৃতিতে চীনের সঙ্গে ভারতের চলতি সীমান্ত সঙ্কটের কোনো উল্লেখ নেই। বেইজিংয়ের ইন্ধন সত্ত্বেও কাশ্মির নিয়েও ভারতকে খোঁচা দিতে যায়নি মস্কো। এই বিষয়গুলোকে খতিয়ে দেখে নয়াদিল্লি মনে করছে, চীন-রাশিয়ার এই হইচই খুব বেশি দিন স্থায়ী হবে না। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আগের মতো সুমধুর নেই বটে, কিন্ত যা রয়েছে— তা উভয় রাষ্ট্রের পক্ষে লাভজনক। ফলে রাশিয়া, আমেরিকা এবং চীন এই তিনটি দেশের সঙ্গেই পৃথক পৃথকভাবে ভালোমন্দ মিশিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বহাল রাখাটাই কর্তব্য বলে মনে করছে নয়াদিল্লি।