বুল্লি বাই থেকে সুল্লি ডিলস: একের পর এক মুসলিমবিদ্বেষী অ্যাপ কেন দেখা দিচ্ছে গিটহাবে?
২০১৮ সালে গিটহাব অধিগ্রহণ করে মাইক্রোসফট। সে সময় বিশ্বের বৃহত্তম ওপেন-সোর্স সফটওয়্যারের এই ভান্ডারকে ঘিরে চলমান বিতর্ক মাইক্রোসফট প্রশমিত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সবাই।
এর মধ্যে অন্যতম উদ্বেগ ছিল গিটহাব তখনও ডিপফেক কোড হোস্ট করা চালিয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারকাদের চেহারা পর্নোগ্রাফিক ভিডিওতে বসিয়ে দেওয়া হতো। আর এ কাজ করা হতো ওই তারকাদের অনুমতি না নিয়েই।
ব্যবহারকারীদের সব আশঙ্কা সত্যি না হলেও চার বছর পর ঠিকই নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে গিটহাব।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ভারতের শত শত মুসলিম নারী দেখেন, তাদের নাম ও টুইটার প্রোফাইল উঠে গেছে এক ‘বুল্লি বাই’ নামক এক ভুয়া নিলামের ওয়েবসাইটে। কাজটি করা হয়েছে তাদের অজান্তে, তাদের অনুমতি না নিয়েই। আর বুল্লি বাই অ্যাপের কোড হোস্ট করা হয়েছিল গিটহাবে। উল্লেখ্য, ভারতে মুসলিম নারীদের গালি দেওয়ার জন্য বুল্লি বাই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার শিকার হয়ে তড়িঘড়ি করে অ্যাপটি নামিয়ে নেয় গিটহাব।
গত সাত মাসে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভারতে মুসলিম নারীদের টার্গেট করা হয়েছে। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই গিটহাবেই ‘সুল্লি ডিলস’ নামক আরেকটি ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন হোস্ট করা হয়। ওই অ্যাপেও মুসলিম নারীদের নিলামে তোলা হয়। সরিয়ে নেওয়ার আগে কয়েক সপ্তাহ অনলাইনে বহাল তবিয়তে ছিল অ্যাপটি।
বুল্লি বাইতে যেসব নারীদের টার্গেট করা হয়েছে, তাদের অনেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের কড়া সমালোচক। তাদের অনেকেই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদির মনোভাব ও কার্যকলাপের সমালোচনা করেছেন।
কাশ্মিরভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক কুরাতুলাইন রেহবার। তিনিও ছিলেন বুল্লি বাইয়ের টার্গেটে। তিনি বলেন, এরকম অ্যাপ হোস্ট করার দায় গিটহাবেরও নেওয়া উচিত।
সংবাদমাধ্যম রেস্ট অভ দ্য ওয়ার্ল্ডকে রেহবার বলেন, ‘ঘৃণা ছড়ানোর জন্য কারোরই উচিত নয় কোনো প্ল্যাটফর্ম দেওয়া। তাহলে এটা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হবে।’
বিশ্বজুড়ে ৭৩ মিলিয়ন ডেভেলপার গিটহাব ব্যবহার করেন। কোড শেয়ার করার জন্য সামাজিক নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গিটহাবকে ব্যবহার করেন তারা। এসব কোড সার্চ, পুনর্ব্যবহার করা যায়। এমনকি কোনো ত্রুটি থাকলে যেকোনো ডেভেলপার কোডগুলো সংশোধনও করতে পারেন। ২০২১ সালে গিটহাবে সবচেয়ে বেশি কোড শেয়ার করেছেন ভারতের ডেভেলপাররা। গত বছর ৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন ভারতীয় ডেভেলপার এ গিটহাবে কোড শেয়ার করেন।
অভিযোগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত আপলোড করা কোড মডারেট করে না গিটহাব। ব্যবহারকারীরা এরকম অবাধে কোড আপলোড করতে পারে বলে বেশ কিছু সরকার গিটহাবকে সেন্সরশিপ ও ব্লকেজের আওতায় এনেছে।
প্ল্যাটফর্মটি অতীতেও বেশ কয়েকবার বিপদে পড়েছে। ২০১৩ সালে চীনে ব্লক করে দেওয়া হয় গিটহাবকে। তার দু-বছর পরই কোড শেয়ারিং সাইটটি বড়সড় ডিনায়াল-অভ-সার্ভিস আক্রমণের শিকার হয়। আক্রমণটি এসেছিল চীনা সরকারের তরফ থেকে। বলা হয়েছিল, প্ল্যাটফর্মটিতে শেয়ার করা রাজনৈতিক তথ্যে জন্য আক্রমণ করা হয়েছে। অবশ্য ওই আক্রমণের পরই চীনে গিটহাব আনব্লক করে দেওয়া হয়। প্ল্যাটফর্মটি রাশিয়া, তুরস্ক ও ভারত সরকারের তরফ থেকেও এমন ব্লকের শিকার হয়েছে।
তবে এবার কোড মডারেশনের দাবিটি এসেছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। অন্যদিকে ডেভেলপার ও অ্যাক্টিভিস্টদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন এসেছে: গিটহাবের মতো একটি কোম্পানি কোন যুক্তিতে মুছে দেওয়া কনটেন্ট আবার ফিরিয়ে আনা ঠেকাতে পারে না?
ডিজিটাল অধিকার আইনজীবী পদ্মিনী রায় মারে বলেন, সুল্লি ডিলস ও বুল্লি বাই—দুটি ঘটনার কোনটির বেলায়ই গিটহাব ইন্ডিয়া পর্যাপ্ত সাড়া দেয়নি। একের পর এক ক্লোন অ্যাপ দেখা দিতে থাকায় মারে টুইটারে প্রশ্ন তোলেন: যেসব কনটেন্ট গিটহাব ও গিটহাব ইন্ডিয়ার নীতিমালার পরিপন্থী, প্ল্যাটফর্মটি সেগুলো ঠিকমতো মনিটর করে সরিয়ে ফেলতে পারছে না কেন? তিনি গিটহাবের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
মারে বলেন, ২০২১ সালে সুল্লি ডিলস সরিয়ে নেওয়ার পরও এই ইস্যু নিয়ে গিটহাব কখনও কোনো ব্লগ প্রকাশ করেনি, এমনকি তদন্তও করেনি। তাছাড়া যেসব কোড সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উসকে দেয়, সেগুলোকে কীভাবে মডারেট করে, তা-ও স্পষ্ট করেনি কখনও।
মডারেশনের ব্যাপারে রেস্ট অভ দ্য ওয়ার্ল্ড গিটহাবকে কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্ন করে, কিন্তু প্ল্যাটফর্মটি কোনো উত্তর দেয়নি। যদিও কোম্পানিটির একজন মুখপাত্র ফিরতি ইমেইলে বলেছেন যে, নিপীড়ন, বৈষম্য ও সহিংসতা উসকে দেয় এমন কনটেন্ট ও আচরণের বিরুদ্ধে নীতিমালা রয়েছে গিটহাবের।
গিটহাব যখন সমালোচনার বাণে জর্জরিত তখন নীতিমালা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সমস্যার সমাধান করাটা কঠিন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বুল্লি বাইয় অ্যাপের মাত্র একটি বাক্যে পরিবর্তন আনলেই এটি আর গিটহাবের নীতিমালার পরিপন্থী থাকবে না। অর্থাৎ নীতিমালা ও আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে এ ধরনের অ্যাপ বহাল তবিয়তে থেকে যাবে।
আপত্তিকর কন্টেন্ট শেয়ার করা নিয়ে এবারই প্রথম নয়, আগেও ঝামেলায় পড়েছে গিটহাব। শিক্ষাগত উদ্দেশ্য দেখিয়ে গিটহাব ডিপফেক কোড হোস্ট করে গেছে। ২০২০ সালের শেষ দিকে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগে ইউটিউব-ডিএল সরাতে বাধ্য হয়। এই ফ্রি সফটওয়্যার টুল ব্যবহার করে ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোড করা যেত। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরই যেসব অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও প্রমাণ জোগাড়ের জন্য এই টুল ব্যবহার করত, তাদের দাবিতে ফের ইউটিউব-ডিএল ফিরিয়ে আনে গিটহাব।
চেন্নাইভিত্তিক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও অনলাইন গোয়েন্দা সৈয়দ সামি বলেন, একটি প্রিস্ক্রিনিং মেকানিজম তৈরি করতে পারলে এই প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার ঠেকানো সহজ হবে। এই মেকানিজম চালু করলে একটি পেজ যে ব্যক্তি তৈরি করে তার নাম ও ওই পেজ তৈরির উদ্দেশ্য তালিকাভুক্ত করতে হবে। সেই তালিকা দেখে গিটহাব ওই পেজকে সবুজ সংকেত দেবে।
তবে আগেভাগেই সেন্সরশিপের কাঁচির নিচে ফেলে দেওয়ার ঝামেলাও আছে। এটি ওপেন সোর্স প্রকল্পগুলোর নীতিমালাবিরোধী। এই সেন্সরশিপ চালু করলে অনেক নিরীহ, অক্ষতিকর অ্যাপকেও মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হতে পারে। এমনকি সামিও মডারেশনের জটিলতা স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই ইস্যুতে গিটহাব খুব একটা সাহায্য করতে পারবে না।’