উন্মোচিত হচ্ছে না মাহমুদ আব্বাসের রাজনৈতিক দিগন্ত
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্টজ গত ২৮ ডিসেম্বর বেনি গান্টজের বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বর্তমান ইসরাইলি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটি হলো তাদের মধ্যে দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক বৈঠক। দু’জন গত আগস্টে বৈঠক করেছিলেন এবং কয়েক সপ্তাহ আগে তারা টেলিফোনে কথা বলেন।
গান্টজ এবং আব্বাস ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) এবং ইসরাইলি সরকারের মধ্যকার নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। তারা পশ্চিমতীরের মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কট লাঘবে পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারেও মতবিনিময় করেছেন।
উভয় পক্ষ থেকেই এই বৈঠককে বিতর্কিত হিসেবেই দেখা হচ্ছে। হামাস ও ফিলিস্তিনের অন্য উপদলগুলো এই বৈঠককে অন্তঃসারশূন্য বলে ঘোষণা দিয়েছে- কারণ তা কোনোভাবেই ফিলিস্তিনের জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। অপর দিকে ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনের সদস্যসহ ইসরাইলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি এটিকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি অসঙ্গত বা অন্যান্য ‘সুবিধা’ প্রদানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
গান্টজ এবং আব্বাস তাদের মধ্যকার বৈঠক যে বিতর্কের জন্ম দেবে, হয়তো সেটি আশা করেননি। তাহলে কেন তারা যেকোনোভাবে সামনে এগোবেন? দু’পক্ষই তাদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখলে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাতের পরিণতি কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রশাসনের অধীনে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আইসোলেশন তথা বিচ্ছিন্ন থাকার পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে আব্বাস আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অবশ্য ইতোমধ্যে ইসরাইলের দীর্ঘ দিনের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়ার প্রেক্ষাপটে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কারণেও মাহমুদ আব্বাসের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
গত জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সম্ভবত মনে করেছিলেন, গান্টজের সাথে তার যোগাযোগ করার সর্বোত্তম সুযোগ হবে। তিনি আশা করেছিলেন, ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়তো পরলোকগত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন। উল্লেখ্য, রবিন ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্ক রাখতে চেয়েছিলেন; এমনকি তিনি ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে একটি ‘শান্তিচুক্তি’ও স্বাক্ষর করেছিলেন।
মাহমুদ আব্বাস একটি রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচনের আশায় গান্টজের বাসভবনে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘অসলো চুক্তি’র পথকে সচল করা তথা ওই চুক্তি অব্যাহত রাখার ব্যাপারে আলোচনা করতেই সেখানে গিয়েছিলেন। আব্বাস অসলো চুক্তির একজন গডফাদার ছিলেন; কিন্তু ইসরাইলে কেউ ফিলিস্তিনিদের সাথে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নয়। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট জানিয়েছেন, তার সরকারের কেউ এ ব্যাপারে আগ্রহী নন। তাই আব্বাস তার কাছ থেকে কেবল কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয় আদায় করতে সক্ষম হন। এসব ব্যবস্থা বা পদক্ষেপের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক সঙ্কট লাঘবে কিছুটা সহায়ক হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইসরাইল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ৩২ মিলিয়ন ডলারের ট্যাক্সমানি অগ্রিম পরিশোধ করবে। এ ছাড়াও ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের জন্য আরো ওয়ার্কপারমিট এবং ফিলিস্তিনি ব্যবসায়ীদের জন্য এন্ট্রি পারমিট সরবরাহ করবে।
ইসরাইলি মিডিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী, গান্টজ আব্বাসকে জানান, ইসরাইলি সরকার পশ্চিমতীর থেকে ছয় হাজার ফিলিস্তিনিকে এবং গাজা ভূখণ্ড থেকে সাড়ে তিন হাজার ফিলিস্তিনিকে ফিলিস্তিন পপুলেশন রেজিস্ট্রিতে তালিকাভুক্ত করে আইডেন্টিফিকেশন ডকুমেন্ট পাঠাতে সম্মত হয়েছে। এই তালিকাভুক্তির বিষয়টি সরাসরি ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ইসরাইলের অনুমতি ব্যতীত তালিকায় আর একজনকেও যোগ করতে পারবে না। ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তালিকাভুক্তির বাইরে রয়ে যাবে।
আব্বাসের সাথে যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা গান্টজকে ফিলিস্তিনিদের ফাইলটি পুরোপুরি নড়াচড়া করার সুযোগ করে দেয়া এবং বিষয়টিকে ব্যবহার করে তিনি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার অবস্থানকে আরো দৃঢ় করার ক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হন। এই উদ্যোগ তাকে বাইডেন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দেয়। উল্লেখ্য, বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলি সরকার ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ উভয়ের প্রতি আলোচনা শুরু করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। এই উদ্যোগের কারণে গান্টজ বেনেটের পাশে দাঁড়ানোর ও অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। কারণ কোয়ালিশনের ডানপন্থী মিত্ররা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ বা সম্পৃক্ততার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিল। বেনেট, ডানপন্থী মিত্ররা তাকে ত্যাগ করবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন।
বর্তমান ইসরাইলি সরকার চরম বা উগ্রডানপন্থী হওয়া সত্ত্বেও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে বিশেষভাবে নিরাপত্তা বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী।
পশ্চিমতীরে গত বছরব্যাপী প্রতিরোধযুদ্ধের বিস্তৃতি, তীব্রতা বৃদ্ধি এবং উপত্যকায় ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধে বসতি স্থাপনকারী ও দখলদার বাহিনীর সহিংসতার মধ্যেই আব্বাসের সাথে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। ওই সব হামলায় বহু ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি মৃত্যুবরণ করে এবং আহত হয়।
গান্টজ এবং বেনেট উভয়ে জানেন, পশ্চিমতীরের হাজার হাজার অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীর নিরাপত্তা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিছু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিনিময়ে আব্বাসের কাছ থেকে এ ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা চান এবং তিনি তা পেয়ে গেলেন।
ইসরাইল সরকারই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিচ্ছে- কারণ অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে পশ্চিমতীরে হামাসের পুনরুত্থানের ব্যাপারে তারা ভীত। আব্বাস এবং গান্টজ-এর মধ্যকার যোগাযোগকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের একমাত্র স্টেকহোল্ডার ওয়াশিংটন মনে হয় স্বাগত জানাবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান উভয় পক্ষকে বিভিন্ন ইস্যুতে কাছাকাছি আনার জন্য এবং উভয় পক্ষের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসন কোনো প্রচেষ্টা না চালালেও ‘নিম্ন’ পর্যায়ের এই যোগাযোগের ব্যাপারে মনে হচ্ছে তারা খুশি। ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিভাজন; তেলআবিবের ডানপন্থী সরকার এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ওয়াশিংটনের নিজের ব্যস্ততার কারণে এ মুহূর্তে আলোচনা পুনরায় শুরু করাটা সম্ভব না হওয়ার প্রতি আমেরিকার একরকম স্বীকৃতি রয়েছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগের ব্যাপারে বেনেট বিরোধিতা করলেও যোগাযোগ তিনি বন্ধ করে দেননি- এর কারণ হলো, ওয়াশিংটনকে তিনি হতাশ করতে চান না। নিরাপত্তা সহযোগিতার বিনিময়ে সীমিত অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ার নীতি ইসরাইল সরকার ও তার মার্কিন মিত্রদের স্বার্থ রক্ষা করলেও তাতে ফিলিস্তিনিদের তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না।
মাত্র কয়েক শ’ ওয়ার্ক এবং এন্ট্রি পারমিট ও অগ্রিম ট্যাক্স মানি ইসরাইলি সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের জীবনমান উন্নয়ন কতটুকুই বা সহায়ক হবে?
ফিলিস্তিনিদের ওপর বসতি স্থাপনকারীদের হামলার ঘটনা যখন ঘটে চলেছে তখন সামান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইসরাইলকে নিরাপত্তা সহযোগিতা দেয়ার এই আহ্বান কতটুকু যৌক্তিক? আর এর মাধ্যমে কি আব্বাসের ভাবমর্যাদা কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হবে?
ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনব্যাপী ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে যে পুনর্জাগরণ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে তাতে ডিভাইড অ্যান্ড রুল কৌশল কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমতীরের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে গাজার ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস কোনো কাজ দেবে না। কারণ গাজার বিষয়টি একটি পৃথক ইস্যু। তাই এই উদ্যোগে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসবে না।
প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক দাবি যতই অস্বীকার করা হবে উত্তেজনা ততই বাড়বে। আর এতে খুব দ্রুত অথবা বিলম্বে তৃতীয় ‘ইনতিফাদার’ উদ্ভব ঘটবে।
লেখক :
- ড. আদনান আবু আমের
গাজার উম্মাহ ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান
আলজাজিরার সৌজন্যে