বিধ্বংসী পররাষ্ট্রনীতির লাগাম টানছে সৌদি
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য কোনো খবরই যেন ভালো খবর নয়। ২০১৫ সালের পর থেকেই এমন ঘটনা দেখা যাচ্ছে। সে সময়কার স্বল্প পরিচিত সালমান সৌদি যুবরাজ থেকে দেশটির ডি-ফ্যাক্টো শাসক হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। তখন থেকেই একের পর এক অঘটন এবং অপকর্মের জন্য দায়ী হয়েছেন তিনি।
ইয়েমেনে ভয়াবহ যুদ্ধ, কাতারের ওপর অবরোধ, লেবাননের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে অপহরণ, সৌদির ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে নৃশংসভাবে হত্যা, সন্দেহজনক অভিযোগে মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার, নগদ অর্থের জন্য রিয়াদের বিলাসবহুল রিটজ-কার্লটন হোটেলে বেশ কয়েকজন যুবরাজ এবং ব্যবসায়ীকে নজরবন্দী করাসহ বহু অন্যায়, অঘটনের মূল হোতা তিনি।
সৌদি অর্থনীতিতে তেলের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা কমাতে চান যুবরাজ সালমান। কিন্তু এসব কাজের কোনটিই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল না। খাশোগির হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল সৌদি আরব আয়োজিত একটি বড় ধরনের বিনিয়োগ সম্মেলনের কয়েক সপ্তাহ আগেই। এই ঘটনার পর বেশ কিছু বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ওই সম্মেলন বর্জন করে। কয়েকজন ব্যবসায়ীকে একটি বিলাসবহুল হোটেলে নজরবন্দী করার ঘটনাও ব্যবসার পরিবেশ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ভালো কোনো বার্তা দেয়নি। ২০১৫ সালে সৌদি আরবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ছিলো ৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে তা কমে হয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
তবে ২০২১ সালে সৌদি আরব তেমন কোনো বড় বিপর্যয়ের ঘটনায় সংবাদের শিরোনাম হয়নি। এর অন্যতম কারণ সৌদি আরবের আত্মোপলব্ধি এবং অহেতুক দ্বন্দ্ব বাড়ে কিন্তু কোনো ভালো ফলাফল পাওয়া যায়না এমন পররাষ্ট্রনীতি থেকে তারা সরে এসেছে।
কাতারকে অবরুদ্ধ করে সৌদি আরব বড় কোনো সাফল্য পায়নি। একইভাবে সাদ হারিরির অপহরণও লেবাননের রাজনীতিতে সৌদি আরবের পক্ষে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরও সৌদি আরব তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাবে। এটা হয়তো পুরোনো দুই শত্রুর মধ্যে একেবারে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে না, তবে ২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনায় ইরান সমর্থিত হামলার মতো প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের ঝুঁকি কমাবে।
দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের নিরাপত্তার জামিনদার হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পর পর তিনজন প্রেসিডেন্টকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন সব পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে যা থেকে মনে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এই ভূমিকা পালনে অনিচ্ছুক। সে কারণে সৌদি আরব হয়তো ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যাবে। গত বছরের আগস্ট মাসে সৌদির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাশিয়ার সঙ্গে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যদিও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা জটিল, এটা বেশিরভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রকে মনোযোগী করার উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সামরিক ও অর্থনৈতিক উভয় সম্পর্কই আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিজ দেশে যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমানের সমর্থকরা মনে করেন, তিনি তার অবস্থান পরিস্কার করেছেন। তার সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে নতুন যুগের সূচনা হবে। তিনি হবেন সৌদির নতুন প্রজন্মের প্রথম শাসক। ১৯৫৩ সাল থেকে সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের বয়স্ক ছেলেরাই সৌদি আরব শাসন করে আসছেন। স্বাভাবিকভাবেই এত বড় একটি রাজপরিবারে মুহাম্মাদ বিন সালমানের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। অনেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট।
এরপরেও যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের অবস্থান নিরাপদ বলেই মনে হয়। দেশের ভেতরে তিনি বেশ জনপ্রিয়। এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব কমিয়ে তিনি সৌদি আরবের পরিবেশকে তুলনামূলক সহনশীল করে তুলেছেন বলেও মনে করে অনেকেই। তবে জনপ্রিয় থাকার জন্য তাকে দ্রুত বেকারত্ব হ্রাস করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মহামারির কারণে দেশটিতে বেকারত্ব ১১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। এপ্রিলে একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চাকুরিরত সৌদিদের অর্ধেক মানুষ কর্মক্ষেত্রে ভালো নেই। তারা ন্যায্য বেতন পাচ্ছেন না।
এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য যুবরাজ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল হাজার ফুল ফুটতে দেওয়া। (আক্ষরিক অর্থেই মে মাসে তিনি মরুভূমিতে এক হাজার কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন)। ২০২২ সালে তিনি হয়তো আরও কিছু সুচিন্তিত গঠনমূলক উদ্যোগ নেবেন। পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে সফল প্রতিবেশীদের অনুকরণ করতে হবে এবং তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।
এক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট পন্থা হলো উপসাগরের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় অর্থনীতির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ব্যবসায়ে দখল বাড়ানো। গত জুলাই মাসে আমিরাতি পণ্যের উপর আরোপিত নতুন শুল্ক ৩৩ শতাংশ কমিয়েছে সৌদি। এছাড়া গত সেপ্টেম্বরে দুটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রচারমাধ্যমকে দুবাই থেকে তাদের কর্মীসহ সদর দপ্তর রিয়াদে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সৌদির বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে একই কাজ করার জন্য চাপের সম্মুখীন হতে হবে। ২০২২ সালে এই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। তবে এটি অন্তত পক্ষে রক্তপাতহীন হওয়া উচিত।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট