গরিবদের কথা ভাবে না ভারত সরকার
গত এক দশকের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ভারতের ভাবা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারকে দেওয়া বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। অমর্ত্য সেন বলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টির বিপরীত দিকে রয়েছে ভারত। এটি দেশটির গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসেও ভারতে বৈষম্য বেড়েছে। গণতন্ত্রের অবনতি হয়েছে। গণতন্ত্রের সঙ্গে মূল্যবোধ ও ন্যায়পরায়ণতার সম্পর্ক রয়েছে। সরকার জনগণের প্রয়োজন ও সমস্যা নিয়ে কতটা ভাবছে, সে বিষয়ও গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার দরিদ্রদের এবং তাদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয় না। অমর্ত্য সেন তাঁর আত্মজীবনী ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’–এও এসব বিষয় এর আগে তুলে ধরেছেন।
বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধবিষয়ক আইন
ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের অধীনে আনলফুল অ্যাকটিভিটিস অ্যাক্টের (বেআইনি কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ আইন) প্রয়োগ নিয়ে সমালোচনা করেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। তিনি এ পরিস্থিতিকে ব্রিটিশ আমলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে অমর্ত্য সেনের কাকাদের এ আইনের আওতায় কারাগারে রাখা হয়। সে সময় এ আইনের আওতায় কোনো অপরাধ করার জন্য নয়, কোনো অপরাধ করতে পারেন বলে তাঁর কাকাদের কারাগারে নেওয়া হয়।
অমর্ত্য সেন বলেন, আনলফুল অ্যাকটিভিটিস অ্যাক্ট ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য ভালো নয়। এ আইনের কারণে কোনো অপরাধ বা আদালতে নিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত কারণ না থাকলেও মানুষকে আটক করা সম্ভব হয়। এ আইনে কোনো অপরাধ করতে পারে—এমন ইস্যুতে মানুষকে কারাগারে রাখা হতে পারে।
অমর্ত্য সেন বলেন, ‘আমি আশা করিনি, ভারতে এ আইনের প্রয়োগ চলতে থাকবে। কিন্তু এটি চলছে। কংগ্রেস শাসনামলেও এ আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে। আর এখন এ আইনের প্রয়োগ অনেক বেশি হচ্ছে। ইউএএপি আইন প্রয়োগ কেবল ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্যই খারাপ নয়, এটি শিক্ষাব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের জন্যও ক্ষতিকর।’
দরিদ্রদের কথা ভাবে না ভারত সরকার
সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেন, মহামারির সময়ে সরকার লকডাউন ঘোষণা করল। হঠাৎ মানুষকে বলা হলো তাঁরা ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না। দিনমজুরদের জন্য ঘরের বাইরে যেতে না পারার অর্থ হলো না খেয়ে থাকার আদেশের মতো।
নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দরিদ্রদের গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তখনই এমনটা ঘটে। আর এ ধরনের পরিস্থিতি গণতন্ত্র না থাকার ইঙ্গিত দেয়।
অমর্ত্য সেন বলেন, এ ধরনের সমস্যার বড় কারণ হলো কেন্দ্রীয় সরকার দরিদ্রদের এবং তাদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয় না। গণতান্ত্রিক নীতিতে এটি বিপজ্জনক লক্ষণ। তিনি বলেন, অতিদরিদ্রদের পক্ষে সরকারের মনোযোগ পাওয়া খুব কঠিন। সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতা দরিদ্রদের নেই। গণতন্ত্র দুর্বল হলে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। এ সময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া খুব দুর্বল হয়। দেশের সবার জন্য এর প্রতিকার করা জরুরি।
বহুদলীয় গণতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ। পার্লামেন্টে যদি একটি দলের আধিপত্য থাকে, তাহলে তারা যা ইচ্ছা করতে পারে। বিচার বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আইনসভাকে বেশি শক্তিশালী করে তুলতে পারে। আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার দিকে নজর দিতে হবে। যদি নির্বাহী বিভাগ অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তাহলে এই পার্থক্য বেশি ধরা পড়ে।’ এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন ভারতে সালমান রুশদির বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা উল্লেখ করেন।
অমর্ত্য সেন বলেন, এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এর আগেও ঘটেছে। তবে এখন সেগুলো নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। কারণ, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব বেশি দেখা গেছে। এ রকম ঘটলে স্বাধীনতা, শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অমর্ত্য সেন আরও বলেন, ‘দলিত ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা এখন ভয়ংকর সময় পার করছেন। আর এভাবেই বৈষম্য ও অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের এটা বদলাতে হবে।’ তবে নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কথা উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সেখানে কিছুটা হলেও এসব ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দেউলিয়া হয়ে গেছে—এমন একটি ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি আমরা।’
নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে একটি দলের সুবিধা অনুযায়ী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার অভিযোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার, সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে গণতন্ত্র। কিন্তু পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে।
স্কুলে শিক্ষাব্যবস্থা
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দুই বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থা এবং দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার প্রসঙ্গেও কথা বলেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, স্কুলশিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি অনেক বেশি চিন্তিত। তবে এই দুশ্চিন্তা শুধু গত দুই বছরের মহামারি পরিস্থিতির কারণে নয়। ভারতের স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘মহামারি না থাকলেও স্কুলের এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা কিছু পাব না।’
অমর্ত্য সেন বলেন, শিক্ষায় স্বাধীনতা প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষা যদি কেবল জাতীয়তাবাদ দিয়ে পরিচালিত হয়, তাহলে সেটা বড় ধরনের ভুল। গত এক দশকে জাতীয়তাবাদ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত করার এ প্রবণতা বেড়েছে। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন, যেটা স্বাধীন চিন্তাচেতনার প্রতিফলন ঘটায়। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকা ও শিক্ষকদের অভাব শিক্ষা খাতে সংকটের একটা কারণ। তবে এটা একমাত্র সংকট নয়।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব
ভারতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে কৃষকদের আন্দোলনে সাফল্য নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের দুটোই প্রয়োজন। যখন কোনো একটি সমস্যা আমাদের সামনে আসে, তখন প্রথমেই ভাবতে হবে এর কারণ কী। এ জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান প্রয়োজন। কখনো কখনো আমাদের কাজে নেমে পড়তে হয়। তবে সে ক্ষেত্রে ভাবতে হয় কীভাবে কাজটি হবে। নেতৃত্বে কে থাকবে। বিচার বিভাগ যদি এসবের সমাধান দিতে পারে, তাহলে সেটা খুব ভালো। অনেক ক্ষেত্রে এমনটা হয়। সেটা না হলে খুবই দুঃখজনকভাবে ব্যর্থতা মেনে নিতে হয়।’
অমর্ত্য সেন বলেন, ‘জনবিক্ষোভ আমাদের বুঝিয়ে দেয়, আমাদের যা করা উচিত আমরা তা করছি না। সংকীর্ণমনা সংখ্যাগরিষ্ঠদের জনগণ বদলাতে পারে না। আমাদের সংকীর্ণমনা সংখ্যাগরিষ্ঠদের টিকে না থাকার দাবি করার মতো কারণ রয়েছে। ভারতে কয়েক শ বছর ধরে হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় বড় ধরনের সমস্যা ছাড়া একসঙ্গে বসবাস করছে। গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবিত সাম্য ও ন্যায়বিচারের আদর্শ অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠরা টিকে থাকতে পারে।’
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, একটি বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি বলি মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব স্বাধীনতাসংগ্রামে আন্দোলনকারী ভারতীয়দের একত্র করেছিল। তাই নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা দূর হবে না। কিন্তু আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার মতো নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে।
ভবিষ্যৎ কী হতে পারে
ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, ইতিহাস বলে, ভারতের গর্ব করার মতো অনেক ঘটনা রয়েছে। তবে তা নিয়ে গর্ব করার পরিবর্তে উল্টো পথে চলার চেষ্টা করলে ইতিহাস ও ভারতের প্রতি অনুগত থাকা যায় না। তিনি বলেন, ‘আমি ভারতীয় হিসেবে গর্ববোধ করি। এ কারণে আমি ভারতীয় পাসপোর্ট রাখি। তবে শুধু গর্ব করার বদলে বৈষম্য দেখলে আমাকে প্রতিবাদ জানাতে হবে। আমার ৮৮ বছর বয়স। আমি বিশ্বাস করি, আমাকে প্রতিবাদ করতে হবে। ভারতের প্রত্যেকের তা করা উচিত। এটা আমাদের দায়িত্বের অংশ। ভারতের সমৃদ্ধ ইতিহাসের উত্তরাধিকারী হিসেবে এটা আমাদের কর্তব্যও।’