নব্য রুশ সাম্রাজ্যের প্রেক্ষাপটে কাজাখস্তানে বিক্ষোভ
সম্প্রতি মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে তীব্র সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। মূলত দেশটির দীর্ঘদিনের শাসক (বর্তমানে ডি ফ্যাক্টো শাসক) নুর সুলতান নাজারবায়েভকে অপসারণ করার জন্য জনগণ তীব্রভাবে মাঠে নেমেছে। অপরদিকে নুর সুলতান নাজারবায়েভের পক্ষে রুশ নেতৃত্বাধীন সিএসটো জোটও সৈন্য পাঠিয়েছে দেশটিতে।
মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্র কাজাখস্তান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র। ১৯৯১ সালে দেশটির স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই নুর সুলতান নাজারবায়েভই দেশটিকে এখন পর্যন্ত শাসন করে যাচ্ছেন। নিজের নামে দেশটির রাজধানীর নামকরণ করা এই ব্যক্তি ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকলেও বর্তমানে সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবেই দেশটির প্রধান হর্তাকর্তা!
নুর সুলতান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের থেকেও বেশি পরিপক্ব। কারণ পুতিনের চেয়েও বেশি সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছেন তিনি। কাজাখ প্রেসিডেন্ট নুর সুলতান এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সম্পর্ক সবসময়ই ভালো এবং তারা ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেই পরিচিত। আর এমন একজন নির্ভরযোগ্য মিত্রের পতন সহজে মেনে নেয়ার দেশ তো রাশিয়া নয়। ফলে কাজাখস্তান আজ নিরীহ নাগরিকদের রক্তে রঞ্জিত। কাজাখস্তানে নতুন করে শুরু হওয়া রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিন্তু রুশদের প্রতিপক্ষ পশ্চিমা দেশগুলোও নিশ্চুপ। এই নিশ্চুপতার পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে পরাশক্তিগুলোর নিজস্ব স্বার্থ!
বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোতে এমন রুশ আধিপত্য অবশ্য নতুন কিছু নয়। ইউক্রেন থেকে জর্জিয়া, বেলারুশ থেকে কাজাখস্তানসহ বেশিরভাগ প্রতিবেশী রাষ্ট্র আজ নব রুশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
নব্য রুশ সাম্রাজ্যের এই উত্থান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
১.
জর্জিয়া, ইউক্রেন, মলদোভার বেশকিছু অংশ নিজেদের দখলে নেয়া এবং কৃত্রিম রুশ নিয়ন্ত্রণিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা!
→ জর্জিয়া
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত এ রাষ্ট্রটি কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী ছোট একটি দেশ। ২০০৬ সালে দেশটির নতুন সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা রুশদের করদ রাষ্ট্র আর থাকবে না, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করবে।
জর্জিয়ার এমন সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ করে রুশ সরকারকে। প্রতিক্রিয়ায় জর্জিয়ার রুশ প্রভাবিত আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়া অঞ্চল থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়।
রুশভাষী আবখাজিয়ান ও ওসেটিয়ানদের রক্ষার অজুহাত দিয়ে ২০০৮ সালে জর্জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে রাশিয়া। কয়েক দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয় জর্জিয়া। ফলে স্বাধীনতা লাভ করে আবখাজিয়া ও দক্ষিণ ওসেটিয়া।
নামকাওয়াস্তে স্বাধীন হলেও মূলত দেশ দুটি রুশ আশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। রুশ বলয়ে থাকা ২/৪টি রাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো দেশ অঞ্চল দুটির স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি।
→ ইউক্রেন!
ইউক্রেনের রুশ আগ্রাসনকে দুভাগে ভাগ করা যায়।
ক. ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে সরাসরি দখল!
কৃষ্ণ সাগরের সবচেয়ে কৌশলগত ভূখণ্ড ক্রিমিয়া উপদ্বীপ আন্তর্জাতিকভাবে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনেরই অংশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনের দখলেও ছিল দ্বীপটি। কিন্তু ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রাজনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে রুশ সামরিক বাহিনী দ্বীপটি দখল করে নেয়।
ভৌগোলিকভাবে ক্রিমিয়ার তিন দিকে সাগর হলেও একমাত্র ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের সাথে ক্রিমিয়ার ভূসংযোগ রয়েছে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল করার পর সরাসরি সংযোগ পেতে রাশিয়া এবং ক্রিমিয়ার মাঝে প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা ব্রিজ নির্মাণ করে রাশিয়া।
খ. ডোনবাস অঞ্চলে রুশ সমর্থিত বিদ্রোহীদের সমর্থন
রাশিয়া-ইউক্রেনের বর্ডারে অবস্থিত ডোনবাস অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সংঘটিত হয় ২০১৪ সালে। মূলত ইউক্রেনের পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার গঠনের পর থেকে ডোনবাস অঞ্চলে অসন্তোষ দেখা দেয়।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে পশ্চিমা বিশ্ব-সমর্থিত এবং ইউরোপমুখী হওয়ার জন্য একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লবের এক মাস পর তথা ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ইউরোপমুখী পশ্চিমা বিপ্লবের বিরোধিতা করে ডোনটেক্স এবং লুহান্স অঞ্চলে (ইউক্রেনের রুশ বর্ডারের দুইটি অঞ্চল, যাদের একত্রে ডোনবাস বলা হয়) রুশপন্থী বিদ্রোহীরা আন্দোলন শুরু করে।
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের সংঘাতের পর রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের ক্রিমিয়াকে রুশ প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার এমন হস্তক্ষেপ দেখে ডোনবাস অঞ্চলের বিদ্রোহীরা ইউক্রেন হতে আলাদা হওয়ার দাবিতে দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে উঠে।
অঞ্চল দুটির বিদ্রোহীরা এই সময় নিজেরা সরকার গঠন করে। ডোনটেক্স ও লুহান্স প্রজাতন্ত্র নামে গঠিত এই দুইটি দেশ মূলত রাশিয়ার মদদপুষ্ট আশ্রিত দেশ হিসেবে ইউক্রেন থেকে পৃথক হয়ে যায়। ডোনটেক্স এবং লুহান্স প্রজাতন্ত্র কে এসময় রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে পরিপূর্ণ সহায়তা করে রাশিয়া।
ডোনটেক্স এবং লুহান্স প্রজাতন্ত্রের এই স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তা করতে ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত দলে দলে রুশ সেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা অঞ্চল দুটিতে আগমন করেন। ইউক্রেন সরকারের মতে ২০১৪ সালে ডোনবাসের বিদ্রোহীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিল রুশ থেকে আগত সামরিক বাহিনী এবং রুশ সেচ্ছাসেবীরা।
ডোনটেক্স এবং লুহান্স প্রজাতন্ত্র গঠনে রাশিয়া তার সম্পৃক্ততা সরাসরি স্বীকার না করলেও পিছনে যতটা সম্ভব রাশিয়া কর্তৃক এই অঞ্চলের বিদ্রোহীদের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানেও অঞ্চল দুটিকে ঘিরে অস্থিরতা বিদ্যমান। ইউক্রেন তার এই ভূখণ্ড হারাতে কোনোমতেই ইচ্ছুক না। কিন্তু রুশ ভাল্লুকের মদদপুষ্ট বিদ্রোহীদের একা দমন করাও অনেকটা অসম্ভব ইউক্রেনের জন্য!
→ মলদোভা!
মলদোভার ট্রান্সনিস্তিয়ান অঞ্চলটির সাথে সরাসরি রাশিয়ার কোনো ভূসংযোগ না থাকলেও কৌশলগত কারণে এ অঞ্চলটির গুরুত্ব রাশিয়ার জন্য বহু। একে তো ট্রান্সনিস্তিয়ান একটি রুশভাষী অঞ্চল, পাশাপাশি দানিয়ুব নদীর প্রবেশমুখ অঞ্চলটির কৌশলগত গুরুত্বও কম না। কারণ এই দানিয়ুব নদীর ওপর ইউরোপের এক ডজন রাষ্ট্র বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিকভাবে বহুলাংশে নির্ভরশীল।
মলদোভার ট্রান্সনিস্তিয়ান অঞ্চলটিতে রুশরা অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য শুরুতেই নানা রকমের প্রোপাগাণ্ডা শুরু করে। রুশ মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করতে শুরু করে যে মলদোভা এবং রোমানিয়া মিলিত হয়ে গ্রেটার রোমানিয়া গঠন করবে। রুশ প্রোপাগান্ডায় দাবি করা হয়, এতে করে মলদোভায় বসবাসকারী রুশরা হয়ে উঠবে অধিকার বঞ্চিত সংখ্যালঘু জাতি।
আর তাই সংখ্যালঘু রুশ জনগণের পাশে অবস্থান নেয়ার অজুহাতে ১৯৯২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মলদোভার ট্রান্সনিস্তিয়ান অঞ্চলে রুশ সামরিক বাহিনী তার অবস্থান বজায় রেখেছে।
২.
বেলারুশ, আর্মেনিয়া, সিরিয়া, লিবিয়ায় রুশ সৈন্যের সমাবেশ
→ বেলারাশ!
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুক্ত বেলারুশ এবং আর্মেনিয়া ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়া এবং লিবিয়াতেও রয়েছে রুশ সৈন্যের কার্যকরী উপস্থিতি।
বেলারুশে রুশ সৈন্য টিকিয়ে রেখেছে দেশটির বর্তমান রুশপন্থী শাসককে। ভৌগোলিক দিক থেকে রাশিয়া এবং ইউরোপের মাঝে অবস্থিত হওয়ায় দেশটির গুরুত্ব ইউরোপের জন্য অনেক। অপরদিকে রাশিয়া কর্তৃক বেলারুশকে মনে করা হয়, রুশ নিরাপত্তার রেডলাইন।
আর তাই বেলারুশে নিজ মিত্র সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সবরকম কার্যক্রমই করে এসেছে রাশিয়া।
→ আর্মেনিয়া!
সম্প্রতি নাগার্নো কারাবাখ যুদ্ধে একরকম নিশ্চুই ছিল রাশিয়া। এ যুদ্ধে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া হেরে যায় আজারবাইজানের কাছে। কিন্তু কৌশলগত কারণে যুদ্ধ শেষে লাভের একটা ভাগ পেয়ে যায় রাশিয়াও।
যুদ্ধে অংশ নেয়া আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয় দেশই রাশিশাকে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে মেনে নেয়। আর তাই যুদ্ধ শেষে এই দুই দেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে মোতায়েন রয়েছে রুশ মিলিটারি।
→ সিরিয়া, লিবিয়া।
সিরিয়ার আসাদ রেজিমকে টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার সীমাহীন সাহায্য সম্পর্কে পুরো বিশ্বই ওয়াকিবহাল। বিশ্বের সবগুলো পরাশক্তি এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলির (ইরান বাদে) বিপক্ষে গিয়ে আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পারাটা রুশ সামরিক বাহিনীর এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জনই বটে।
এদিকে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এলএনএ সরকারেরও অন্যতম ব্যাকআপ রাষ্ট্র হলো রাশিয়া। লিবিয়ার একটা অংশে নিয়ন্ত্রণ থাকায় খুব সহজেই ভূমধ্যসাগর এবং উত্তর আফ্রিকার রাজনীতি পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে দেশটি।
→মিসর, সুদান, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র!
কৌশলহতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই তিন আফ্রিকান দেশে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করবে রাশিয়া। ফলশ্রুতিতে আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ঢুকার যথেষ্ট সুবিধা পাবে দেশটি।
৩.
কাজাখস্তানে এত সম্পদ!
মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র কাজাখস্তান রাশিয়ার জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতিবেশী। রাশিয়ার সাথে বিশাল সীমান্ত, ২৫ ভাগ রুশভাষী জনগণের বসবাস ছাড়িয়ে অঞ্চলটি রাশিয়ার কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তার ব্যাপক খনিজ মজুদের জন্য!
→ কাজাখস্তান প্রতিদিন ১.৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করে। যা বিশ্বের মোট চাহিদার ২ ভাগ। অপরিশোধিত তেল রফতানির তালিকায় বিশ্বে দেশটির অবস্থান নবম। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, তেল রিজার্ভের দিক থেকে বিশ্বে ১২ তম অবস্থানে আছে দেশটি। তবে ধারণা করা হয় মজুদ বৃদ্ধির নিরিখে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি ৫ম তম অবস্থানে চলে আসবে বিশ্বের মধ্যে।
→ প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানিতে বিশ্বে ১২ তম অবস্থানে রয়েছে কাজাখস্তান। প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন তার মোট চাহিদার ২৫ ভাগ গ্যাস আমদানি করে কাজাখস্তান থেকে।
এক হিসেবে জানা যায়, প্রতিদিন চীনে ২৭ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস রফতানি করা হয় কাজাখস্তান থেকে। ফলে কাজাখস্তানের গ্যাসলাইনের ওপর হামলা অথবা কাজাখস্তানের রাজনৈতিক স্থবিরতা চীনের বিশাল অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
→ কয়লা রফতানিতেও বিশ্বে ৯ম অবস্থানে রয়েছে কাজাখস্তান এবং কয়লা রিজার্ভে তাদের অবস্থান বিশ্বে ১০ম।
→ বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ ইউরোনিয়ামের অন্যতম উৎপাদক রাষ্ট্র হলো কাজাখস্তান! বিশ্বের মোট ইউরোনিয়ামের ৪০ ভাগ যোগান আসে কাজাখস্তান থেকে।
আর তাই চলমান অস্থিরতার জন্য বিশ্ব বাজারে ইউক্রেনের দাম ইতোমধ্যে ৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ দীর্ঘদিনের নির্ভরযোগ্য সরবরাহদাতা কাজাখস্তান আজ সরকার বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল।
→ চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয়রনের মজুত রয়েছে কাজাখস্তান। পাশাপাশি কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকন, ক্রোমিয়াম সহ বেশিরভাগ মূল্যাবান ধাতু উৎপাদিত হয় কাজাখস্তানে। কপার উৎপাদনে দেশটির অবস্থান ১০ম।
আর তাই কাজাখস্তানের চলমান অস্থিরতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে বিশ্বের স্টিল এবং নির্মাণ খাতগুলো।
→ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রা বিটকয়েনের দ্বিতীয় যোগানদাতা দেশ কাজাখস্তান। বিটকয়েনের ১৮ ভাগ উৎপাদন আসে কাজাখস্তান থেকে।
অর্থাৎ বলা যায়, বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক, জ্বালানি, নির্মাণ, মুদ্রাসহ বড় সবগুলো সেক্টরের কাঁচামালের অন্যতম যোগানদাতা রাষ্ট্র হলো কাজাখস্তান। স্বাভাবিকভাবেই কাজাখস্তানে অস্থিরতা তৈরি হওয়া মানে বিশ্বের মেজর অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোতে স্থবিরতা নেমে আসা। কিন্তু অজনপ্রিয়, একনায়কতন্ত্রের শাসককে ক্ষমতায় রেখে পশ্চিমা বিশ্ব, রাশিয়া ও চীনের লাভটা কি?
৪.
কাজাখস্তানে রুশ-সমর্থিত সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সামরিক অভিযান!
কাজাখস্তানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী তাদের সম্পদের বেশিরভাগই ইউরোপে বিনিয়োগ করে রেখেছে। আর তাই এই শাসকশ্রেণি থাকা মানে ইউরোপীয় দেশগুলোর আর্থিক লাভ। কেননা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে কোনো সরকার কাজাখস্তানের ক্ষমতায় এলে তারা দেশের বাইরে সম্পদ পাচার না করে দেশের কাজেই লাগাবে। কিন্তু কাজাখবাসীর দুর্ভাগ্য, এত বিশাল সম্পদ পেয়েও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকশ্রেণির জন্য তারা আজ বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াবার মতো শক্তি হতে পারেনি।
ভূরাজনৈতিক দিক থেকে কাজাখস্তান সবসময়ই রাশিয়ার অনুগত ছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত এ রাষ্ট্রটি কখনোই ইইউ বা ন্যাটোর সাথে রাজনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টাও করেনি। রাশিয়ার এমন পরম মিত্রের দুর্দিনে তাই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে হলেও কাজাখস্তানে সৈন্য পাঠিয়েছে রাশিয়া।
নিজ দেশের জনগণের ওপর বাইরের দেশের এমন আক্রমণ উপভোগ করে হয়তো আনন্দেই দিন কাটাচ্ছে কাজাখস্তানের শাসকগোষ্ঠী। কারণ তাদের তো মানুষ না, মাটি দরকার!
সব মিলিয়ে বলা যায়, পারষ্পরিক বিরোধ থাকলেও রাশিয়া, চীন ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর কেউই কাজাখস্তানের সাধারণ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। কারণ যত দিন কাজাখস্তানে অজনপ্রিয় সরকার বসে থাকবে, তত দিন দেশটির সম্পদ লুটেপুটেই খেতে পারবে পরাশক্তিগুলো।
অন্য সব পরাশক্তির তুলনায় কাজাখস্তানে রুশদের আগ্রাসন একটু বেশিই চোখে পড়বে। কারণ অন্যরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শোষণের জন্য কাজাখ সরকারকে তোয়াজ করলেও রাশিয়ার এখানে বহুমুখী স্বার্থ বিরাজমান। সামরিক, অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক প্রতিটা দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার জন্য অনুগত কাজাখ সরকারের বিকল্প আর কিছু নেই।
রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো ইউরোপীয় শক্তিই প্রতিরোধ করার সাহস পাবে না৷ কারণ ইউরোপের গ্যাসের প্রধান যোগানদাতা হলো রাশিয়া। জার্মানির ৫৮ ভাগ, ইতালির ২২ ভাগ গ্যাসের যোগান আসে রাশিয়া থেকে। পাশাপাশি ইউরোপের সর্ববৃহৎ জনশক্তিসম্পন্ন এই দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে বিভিন্ন পণ্যের মার্কেট হারাতে নারাজ ইউরোপীয় ব্যাবসায়ীরাও।
তুরস্ক মাঝে মধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে গরম বক্তব্য দিলেও দিনশেষে পুতিনের পিছনেই ছাতা ধরতে বাধ্য তুরস্ক। কেননা তুরস্কের গ্যাসের ২৫ ভাগ আসে রাশিয়া থেকে (সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য এই হার কমে এসেছে)। পাশাপাশি তুরস্কের অন্যতম প্রধান আয়ের খাত পর্যটন শিল্প পুরোপুরি রুশ জনগণের আগমনের ওপর টিকে আছে। রাশিয়া কর্তৃক কোনো প্রকার অবরোধ তুর্কি পর্যটন ব্যাবসাকে পথে বসিয়ে দিতে সক্ষম। এছাড়াও তুর্কি কৃষি পণ্যের অন্যতম বাজার হলো রাশিয়া।
সামরিক দিক থেকে ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল তুরস্ক। বিভিন্ন সমরাস্ত্র ক্রয় ছাড়াও সিরিয়া, লিবিয়া, আজারবাইজানে তুরস্কের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে রুশ মৌনসম্মতির কোনো বিকল্প নেই।
অর্থাৎ বলা যায়, আগামী দিনগুলোতে ইউরোপ আর এশিয়ার বুকে ছড়ি ঘোরাতে রাশিয়ার সামনে আর কোনো বাধা নাই। এখন দেখার বিষয়, এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ লিডার ভ্লাদিমির পুতিন এই ছড়ি ঘুরানোর ক্ষেত্রে তার পূর্ববর্তী রুশ সাম্রাজ্য বা সোভিয়েত ইউনিয়নকে টক্কর দিতে সক্ষম হবে কি না। উরাল পর্বতমালা পেরিয়ে রুশ আধিপত্য এখন ভূমধ্যসাগরের উষ্ণ জলভূমি ছাপিয়ে একদিকে বলকান অন্যদিকে ককেশাস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।
জর্জিয়া, ইউক্রেন, মলদোভা, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, সিরিয়া, তাজিকিস্তান, লিবিয়ার পর কাজাখস্তানে রুশ সৈন্য অবতরণ বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক নতুন প্রেক্ষাপটই বটে। আর তাই বলাই যায়, চারদিকে রুশ সামরিক বাহিনীর দুর্দান্ত আক্রমণ বার্তা দিচ্ছে এক নব্য রুশ সাম্রাজ্যের! আর নতুবা এক গ্রেটার সোভিয়েত ইউনিয়নের।