টাইমের চোখে আলোচিত ছয় মুসলিম নারী

0

১৯২৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন এবং পরবর্তীতে সংযুক্ত ওয়েবসাইট ‘টাইম’ ইংরেজি বছর শেষে সারা বিশ্বের বাছাইকৃতদের মধ্যে থেকে একজনকে ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ বা বছরের আলোচিত চরিত্র নির্বাচন করে। নর-নারীর বাইরেও অনেক সময় বছরের আলোচিত চরিত্র নির্বাচিত হয়েছে। যেমন ১৯৫০ ও ২০০৩ সালে মার্কিন সেনা এবং ১৯৮২ সালে কম্পিউটার ছিল বছরের আলোচিত চরিত্র। এরই ধারাবাহিকতায় একদল জাঁদরেল মিডিয়াকর্মী সারা বিশ্বের নামি-দামি ব্যক্তি, পাঠক ও দর্শকের মতামতের ভিত্তিতে ২০২১ সালের জন্য প্রাথমিকভাবে ১০০ জনকে বিশ্বের আলোচিত চরিত্র বলে লিপিবদ্ধ করে। এই ১০০ জনের মধ্যে আইকন বা অনুকরণীয় রূপে ১৫ জন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী বা পাইওনিয়র রূপে ১৮ জন, গুরুত্বপূর্ণ বা টাইটান রূপে ১৩ জন, শিল্পী ও খেলোয়াড় রূপে ১৬ জন, নেতৃত্বের জন্য ২০ জন এবং নতুন আবিষ্কারের জন্য ১৬ জনের নাম উঠে আসে।  এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ছয়জন মুসলমান নারী।

মাহবুবা সিরাজ

আফগানিস্তান

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার এবং তালেবান সরকার প্রতিষ্ঠার ঠিক ৬ দিন আগে তুরস্কের টিআরটি ওয়ার্ল্ড নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া এক নারীর সাক্ষাৎকার বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে। তিনি আফগানিস্তানের নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এবং আফগান ওমেন্স নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নাম মাহবুবা সিরাজ। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আফগান নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন এবং কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আগে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের কারণে বলেন, ‘সে সব বিশ্ব নেতাকে বলছি; তোমাদের ধিক্কার জানাই। সমগ্র পৃথিবীকে বলছি; তোমরা আফগানিস্তানের জন্য যা করেছ, সেজন্য ধিক্কার জানাই। কেন তোমাদের এমনটা করতে হলো? তোমরা আমাদের ব্যবহার করছ? আমরা কী তোমাদের হাতের পুতুল’। আমেরিকায় বিত্তবৈভবে থাকার সুযোগ থাকলেও আফগান নারী ও শিশুদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সাহসী নারী মাহবুবা সিরাজ ২০০৩ সালে নিজ দেশে ফেরেন। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি নির্মূল এবং ঘরে ঘরে নির্যাতিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছেন। আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণভয়ে দেশ ত্যাগ করেন। কিন্তু আফগান নারী ও শিশুদের কথা ভেবে মাহবুবা সিরাজ দেশেই থেকে যান।

১৯৪৮ সালে মাহবুবা সিরাজের জন্ম হয় এক রাজকীয় পরিবারে। ১৯৭৮ সালে কমিউনিস্ট শাসনের সময় স্বামীসহ তাঁকে জেল খাটতে হয়। এরপর আফগানিস্তানে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হলে দীর্ঘ ২৬ বছর যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী হিসেবে দিন কাটান। ২০০৩ সালে দেশে ফেরার পর থেকে অদ্যাবধি তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার রয়েছেন। তালেবানদের কঠোরতা তাঁকে আদৌ টলাতে পারেনি।  নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষায় অবিচল এই নারীনেত্রীকে নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় শঙ্কিত থাকলেও তিনি আদৌ শঙ্কিত নন।

 

এনগোজি ওকোঞ্জে আইওয়েআলা

নাইজেরিয়া

ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সাধারণ মানুষের কাতারে শামিল হওয়া ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স হেরি ও তাঁর স্ত্রী মেগান মার্কেল টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক মিসেস এনগোজি ওকোঞ্জে আইওয়েআলা সম্পর্কে বলেন, ‘সমগ্র পৃথিবীকে ভ্যাকসিনের বলয়ে আনতে প্রয়োজন একতা, সহযোগিতা এবং এনগোজি ওকোঞ্জে আইওয়েআলার মতো নেতা’।

দুটি নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করে তিনি ২০২১ সালে সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি ২৬ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রথমত একজন নারী এবং দ্বিতীয়ত একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তিনিই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রধান বা মহাপরিচালক নির্বাচিত হন। ১৬৪ দেশ থেকে বাছাই করা অর্থনীতিবিদের মধ্যে তিনিই নিজ যোগ্যতায় এই শীর্ষ পদ অলঙ্কৃত করেন। তাই টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বসেরা ২০ নেতার মধ্যে চীন-মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিংবা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পেছনে রেখে তিনি রয়েছেন শীর্ষে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ’৭৬ সালে অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি এবং ১৯৮১ সালে মাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি (পিএইচ.ডি) অর্জন করেন। এর বাইরে বিশ্বের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ড. ওকোঞ্জেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর তাঁর সাফল্য ও সম্মানের মুকুটে নতুন পালক সংযুক্ত হতে থাকে। তিনি এ যাবৎ বিশ্বের ৫০ জন মহান নেতার একজন, বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী মানুষের একজন, বিশ্বের ১০০ জন বুদ্ধিজীবীর একজন, ১০০ জন ক্ষমতাধর নারীর একজন, আফ্রিকার তিনজন ক্ষমতাধর নারীর একজন, আফ্রিকার ১০ জন প্রভাবশালী মহিলার একজন, বিশ্বের ১০০ জন শীর্ষস্থানীয় মহিলার একজন, বিশ্বের ১০০ জন প্রেরণাদায়ীর একজন এবং বিশ্বের ৭৩ জন বাণিজ্যক্ষেত্রে মেধাবীদের একজন রূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। নাইজেরিয়া, লাইব্রেরিয়া ও আইভোরিকোস্ট ড. ওকোঞ্জেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করে। তাঁর কৃতিত্বের মধ্যে আরও রয়েছে ২১টি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বা এনজিও, চারটি বৃহৎ করপোরেট বোর্ড, ছয়টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং একটি বিদেশি সংস্থার শীর্ষপদে চাকরি করা ও সাফল্য অর্জনের ধারাবাহিকতা। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জাইকা, আফ্রিকা ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইউএনডিপি প্রভৃতি। নিজ দেশ নাইজেরিয়ায় তিনি ২০০৩-২০০৬ এবং ২০১১-২০১৫ এই দুই মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ২০০৬ সালে স্বল্প মেয়াদের জন্য তিনি নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নাইজেরিয়ার আর্থিক ক্ষেত্রে তাঁর অনমনীয় সততা ও দৃঢ়তা দেশটির ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ জন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেননি। এমনকি তাঁর মাকে অপহরণ করেও তাঁকে টলানো যায়নি। টাইম ম্যাগাজিনের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে সমগ্র পৃথিবী যখন করোনার কারণে কাঁদছিল, তখনই তিনি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দায়িত্ব নেন, যে সংস্থা প্রতিটি মানুষ, পরিবার এবং সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতাধর নেত্রী বর্তমানে করোনা মহামারী মোকাবিলায় বিশ্বে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ওপর সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত।

 

নাসরিন সতৌদে

ইরান

পেশায় একজন আইনজীবী হলেও ইরানের অকুতোভয় নারী নাসরিন সতৌদের বড় পরিচয় একজন জেলবন্দী নারী অধিকার নেত্রী হিসেবে। তাঁর জন্ম ১৯৬৩ সালে। আইন বিষয়ে ১৯৯৫ সালে তাঁর শিক্ষা সনদ মিললেও দীর্ঘ আট বছর তাঁর আইন পেশায় ঢোকার অনুমোদন মেলেনি। প্রথম জীবনে সরকারি গৃহায়ণ মন্ত্রণালয় ও একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করলেও ইরানের নারীদের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে তিনি নির্যাতিত রাজনৈতিক মামলার আসামি এবং জেলবন্দী বিশেষত নারী বন্দিদের পাশে দাঁড়ান। এরপর তিনি বহু নির্যাতিত নারী ও শিশুর জীবনের করুণালেখ্য সংগ্রহ করেন এবং তা প্রকাশ ও প্রচারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এই চেষ্টাকে প্রকাশকরা অদৃশ্য ইশারায় দমিয়ে দেয়। তবে দমে যাওয়ার পাত্রী নন নাসরিন সতৌদে। ২০১০ সালে ইরান সরকার প্রথমে তাঁর অফিসে তল্লাশি চালায় এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর গুজব ছড়ানোর দায়ে তাঁকে গ্রেফতার করে। ২০১১ সালে এই অপরাধে তাঁকে ১১ বছরের কারাদন্ড এবং ২০ বছরের জন্য আইন পেশা থেকে দূরে থাকার শাস্তি প্রদান করে। আপিল আদালত দন্ড কমিয়ে ছয় বছরের জেল ১০ বছরের আইন পেশাগত নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। প্রায় তিন বছর জেল খাটার পর ২০১৩ সালে বিরোধীদলীয় একজন রাজনৈতিক নেতা ও নাসরিন সতৌদেসহ ১০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয় জাতিসংঘে ইরানের প্রেসিডেন্ট আলি খোমেনির ভাষণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে। পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে আবারও গ্রেফতার হন নাসরিন। এবারের অভিযোগ গোয়েন্দাবৃত্তি, গুজব ছড়ানো এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খোমেনির প্রতি বিষোদগার। এ ছাড়াও আরও কিছু অভিযোগে দাঁড় করিয়ে ২০১৯ সালে তাঁকে সর্বমোট ৩৮ বছরের জেল ও ১৪৮ ঘা চাবুকের আঘাত দেওয়ার রায় ঘোষিত হয়। তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য তাঁর কন্যাকে আটক করা হলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। নাসরিনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও এ সময় স্তব্ধ করা হয়। জেলে বিভিন্ন অনিয়মের বিরোধিতা করে তিনি ক্রমগত অনশন করতে থাকেন এবং প্রচ- অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০২০ সালে তিনি করোনা আক্রান্ত হন। হয়রানির উদ্দেশে প্রায়ই তাঁর জেল পরিবর্তন করা হয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠন বারবার তাঁর মুক্তি দাবি করলেও জানামতে এখনো বন্দি রয়েছেন ইরানের এই নারীবাদী নেত্রী। ২০২১ সালের সেরা ১০০ ব্যক্তি এবং ১৫ আইকন বা অনুকরণীয় ব্যক্তির মধ্যে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে নাসরিন সতৌদে একজন। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১ বছর বিভিন্ন সংস্থা ১২ বার তাকে বিশেষ সম্মাননা দিয়ে সম্মানিত করেছে। তাঁর জীবনী নিয়ে আমেরিকায় ‘নাসরিন’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে ২০২০ সালে।  এ ছাড়াও ২০১৫ সালে খোদ ইরানে নির্মিত ‘ট্যাক্সি’ ছবিতে তাঁর প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে।

মুনা অ্যালকার্ড

ফিলিস্তিন

আইকন বা অনুকরণীয হিসেবে ‘টাইম’-এর দৃষ্টিতে আরও রয়েছেন ১৯৯৮ সালে জন্ম নেওয়া ফিলিস্তিনি নারী মুনা অ্যালকার্ড এবং তাঁর যমজ ভাই মোহাম্মদ অ্যালকার্ড। শিশুকাল থেকেই এ যমজ ভাইবোন যে কোনো সময় ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে পৈতৃক ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে ওঠেন। ২০০৯ সালে একটি একচেটিয়া ও অগ্রহণযোগ্য আইনের আবরণে ইসরায়েলি ইহুদিরা তাঁদের বাড়ির অর্ধেক দখল করে ফেলে। তখন থেকেই মুনা ও তাঁর মতো আরও ১১টি পরিবার সম্পত্তি রক্ষায় আইনি লড়াই চালিয়ে যায়। মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে ওই পরিবারগুলোকে নিজ ভূমি থেকে সরে যেতে আদেশ দেয় ইসরায়েলি আদালত। এ সময় মুনার ভাই এবং কবি মোহাম্মদ অ্যালকার্ড আমেরিকার উচ্চশিক্ষা ত্যাগ করে ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন এবং ইসরায়েলের এই সমূলে উচ্ছেদের কাহিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে তুুলে ধরেন। ২০২১ সালের ৬ জুন মুনা এবং মোহাম্মদকে ইসরায়েলি পুলিশ আটক করে। প্রথমে মুনাকে আটক করলেও পরে মোহাম্মদ স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দেন। ওই দিনই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেয়। মোহাম্মদ অ্যালকার্ড বর্তমানে আমেরিকার প্রাচীনতম সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘দি গার্ডিয়ান’-এর ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। তিনি সংবাদ, ফিচার এবং কবিতা লিখে থাকেন। এই ভাইবোন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক পরিচিত।  সামাজিক মাধ্যমে মোহাম্মদের ৩ লাখ অনুসারী রয়েছে।

আদি উতারিনি

ইন্দোনেশিয়া

টাইম ম্যাগাজিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী বা পাইওনিয়র হিসেবে উঠে আসা ১৫ জনের মধ্যে অন্যতম ইন্দোনেশিয়ার চিকিৎসক আদি উতারিনির জন্ম ১৯৬৫ সালে। নিজ দেশেই তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া শেষ করেন। এরপর উচ্চতর বা মাস্টার্স শিক্ষাগ্রহণ করেন যুক্তরাজ্য ও সুইডেন থেকে। যুক্তরাজ্যে তিনি শিশু স্বাস্থ্য এবং সুইডেনে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। সুইডেনেই তিনি ইন্দোনেশিয়ার জাভায় পরিচালিত ম্যালেরিয়া বিষয়ক একটি গবেষণা সম্পন্ন করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর নিজ দেশে ফিরে আত্মনিয়োগ করেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ে। বিশেষত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ মশার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ থেকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষের সুরক্ষায় তাঁর অবদান চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করে। তাঁর প্রদর্শিত পদ্ধতি অনুসরণ করে ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের তুলনায় ৭৭ ভাগ কমেছে বলে ২০২০ সালে তিনিই প্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত হাজির করেন। এ সময় অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী জানতে পারে যে, ফড়িং কিংবা প্রজাপতিসহ পৃথিবীর প্রায় ৬০ ভাগ কীটপতঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে ওলবেচিয়া নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা এডিস মশার মাঝে অনুপস্থিত। এই ব্যাকটেরিয়ার কারণেই অন্যান্য কীটপতঙ্গ থেকে ডেঙ্গু ছড়ায় না বলে ধারণা করা হয়। এরপর এডিস মশার ডিম বা শরীরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ওলবেচিয়া ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে দেখা যায় সেসব মশার কামড়ে ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা ৭৭ ভাগ কমে গেছে। এ তথ্যই ২০২১ সালে সারা বিশ্বের চিকিৎসা জগতে হইচই ফেলে দেয় এবং আদি উতারিনিকে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বসেরা ১০০ জন এবং অগ্রপথিক ১৫ জনের মধ্যে একজন হওয়ার গৌরব এনে দেয়। বেশ কিছু চিকিৎসা বিষয়ক প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র লিখেছেন ডা. আদি উতারিনি। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ বেশ কিছু সম্মাননা। সাইকেল চালানো এবং পিয়ানোতে সুর তোলা তাঁর প্রিয় শখ, কিন্তু অভিশপ্ত করোনা তাঁর ব্যক্তিজীবনের সুরে ব্যাঘাত ঘটায় ২০২০ সালের মার্চে।  এ সময় হাজার মানুষের জীবন বাঁচানো ডা. আদি উতারিনি হারান তাঁর প্রিয়তম স্বামী ডা. ইওয়ান ডিপ্রাহাস্টোকে।

 

অ্যাঞ্জেলিক কিডজো

বেনিন

কৃষিপ্রধান পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বেনিনের শিল্পভুবনে গায়িকা, অভিনেত্রী, গীতিকার এবং বিভিন্ন আন্দোলনে অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী হিসেবে সে দেশের সংগীতশিল্পী অ্যাঞ্জেলিক কিডজোর পরিচিতি দীর্ঘদিনের। তবে ২০২১ সালের ২৩ জুলাই জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গেয়ে সারা বিশ্বের দৃষ্টি কাড়েন এবং ২০২১ সালের টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ১০০ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ বা টাইটান শ্রেণিতে ১৩ জনের মধ্যে একজন নির্বাচিত হন। বেনিনে ১৯৬০ সালে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ক্রমাগত রাজনৈতিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে নিজ দেশ ছেড়ে ১৯৮৩ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে পাড়ি জমান। সেখানেই তাঁর সংগীত জীবনে আসে নতুন গতি। ফ্রান্সের খ্যাতনামা সংগীত পরিচালকদের দক্ষ সংগীত পরিচালনা আর অ্যাঞ্জেলিক কিডজোর জাদুকরী কণ্ঠ সংগীত জগতে সৃষ্টি করে নতুন উন্মাদনা। বের হতে থাকে একের পর এক সাড়া জাগানো যত অ্যালবাম। তাঁর ‘ইভ’ শিরোনামের অ্যালবাম ২০১৪ সালে ৫৭তম আসরে গ্রেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। অ্যাঞ্জেলিক কডজো ও তাঁর সঙ্গীদের গাওয়া আরেকটি অ্যালবাম ২০১৫ সালের ৫৮তম আসরে বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক শ্রেণিতে পুরস্কার লাভ করে। ২০২০ সালে কিউবার শিল্পী সেলিয়া ক্রজের সম্মানে নিবেদিত তাঁর ‘সেলিয়া’ শিরোনামের অ্যালবাম ‘বেস্ট ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ শ্রেণিতে লাভ করে গ্রেমি অ্যাওয়ার্ড। মূলত ১৯৯১ সাল থেকে অদ্যাবধি তিনি জিতেই চলেছেন একের পর এক পুরস্কার ও সম্মাননা। ইউনিসেফসহ পাঁচটি আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা তাঁকে শুভেচ্ছা দূতের সম্মান প্রদান করে। ২০২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে এক্সপো ২০২১-এ সংগীত পরিবেশন করেন কিডজো।  এ বছরই ফ্রান্স সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com