মিয়ানমারের ‘বড় ভাই’ হওয়ার চেষ্টায় সফল হবে কি ভারত
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ২২ ডিসেম্বর ২ দিনের সফরে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গিয়েছিলেন। বিগত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির ‘দুর্বল সরকার’কে উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর এটাই ছিল কোনো ভারতীয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সে দেশে প্রথম সফর। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে ভারত মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে স্বীকৃতি দিল। যে স্বীকৃতি চীন দিয়েছে আরও ছয় মাস আগে, জুন মাসে।
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। এর আট মাস পরে ওই বছরের অক্টোবরে মিয়ানমার সফর করেন তিনি। সেবার তাঁর সফরসঙ্গী হন সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নরভানে।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এবারের সফরে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ একটি বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত অশান্ত মিয়ানমারে দ্রুত গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন চায়। একই সঙ্গে প্রত্যাশা করে, দেশটির রাজনৈতিক বন্দীরা মুক্তি পাবেন, সহিংসতা পুরোপুরি বন্ধ হবে, আর সব বিবাদের মীমাংসা হবে আলোচনার মাধ্যমে।
শ্রিংলার সফরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি প্রচার করেছে, তাতে আরও কিছু বিষয় রয়েছে। আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলোর পদক্ষেপের প্রতি ভারতের সমর্থন, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় ‘উন্নয়ন’, বৃহৎ প্রকল্প কালাদান ও ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় হাইওয়ের কাজ এগিয়ে নেওয়া। তবে বিবৃতিতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ-দুর্দশা এবং তাদের নিজভূমে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগের বিষয়ে কোনো শব্দ-বাক্য খরচা করা হয়নি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত ও চীন দুটি দেশই মনে করে, রোহিঙ্গা সমস্যা কেবল বাংলাদেশের একার সমস্যা।
তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, শ্রিংলার ওই সফরে। তা হলো, প্রচেষ্টা চালিয়েও সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারা।
মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক কৌশলগত এবং দৃশ্যত ভালো। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২ দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে অন্তত ৯টি সফর হয়েছে। এসব সফরে স্বাক্ষরিত হয়েছে অসংখ্য চুক্তি ও এমওইউ। নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষায় দুই দেশের সম্পর্কও গভীর। মিয়ানমারে বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধমন্দির নির্মাণসহ করোনাকালে ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করছে ভারত।
এ লেখায় মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের মোড়কে লুকিয়ে থাকা স্বার্থের বিষয়গুলো, চীনসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার নিরিখে ভারতের অবস্থান, শ্রিংলার ‘গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা’ ও অতীতে সামরিক সরকারের সঙ্গে দিল্লির সমঝোতার বিষয়গুলো তুলে আনব, যাতে আগ্রহী পাঠকের কাছে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশ একসময় ব্রিটিশ রাজের অধীনে ছিল। আর ওই ব্রিটিশ ভারতেরই একটি রাজ্য ছিল মিয়ানমার বা বার্মা। ঐতিহাসিকভাবেই শুধু নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও দুটি দেশের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। মিয়ানমারে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ঘটেছে ভারত থেকেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান মিয়ানমার দখল করে নেয়। পরবর্তী সময়ে জাপানকে হটিয়ে দেশটি আবার করায়ত্ত করতে সক্ষম হন ব্রিটিশ শাসকরা। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় মিয়ানমার। স্বাধীনতার পর ভারত-মিয়ানমার আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। মিয়ানমারের সামরিক শাসকের সঙ্গে ভারতের গণতান্ত্রিক শাসকের মৈত্রী তখন থেকেই।
প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বিপুল খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ মিয়ানমার আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কাছে একটি ‘লোভনীয়’ দেশ। তাই ভারত, চীন, রাশিয়া—তিনটি বড় আঞ্চলিক শক্তির নজর দেশটির দিকে।
ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের রয়েছে ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের সীমান্ত। ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত সাত রাজ্যের মধ্যে এই সীমান্তজুড়ে চার রাজ্যের অবস্থান। এই চার রাজ্য হলো—মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশ। অপর দিকে সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাজ্যগুলো হলো কাচিন স্টেট, সাগাইং রিজিয়ন ও চিন স্টেট। দীর্ঘ স্থলসীমান্তের পাশাপাশি ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জজুড়ে রয়েছে দুই দেশের সমুদ্রসীমানা।
অপর দিকে চীন ১৯৯০ দশক থেকেই মিয়ানমারের সঙ্গে তার সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে দেশটির গ্যাসসম্পদের কথা বিবেচনা করে৷ চীন রাখাইনের কিয়াকফুতে গভীর সমুদ্রবন্দর, চীন-মিয়ানমার তেল-গ্যাস পাইপলাইন ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। প্রসঙ্গত, পূর্বাঞ্চলে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশটির নাম চীন।
মিয়ানমারের সব পরিস্থিতিতে চীন ‘বড় ভাই’–এর মতো পাশে থাকে। ছায়া দেয়, আশ্রয় দেয়। ভারতও কয়েক বছর ধরে ‘বড় ভাই’ হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ‘ভাই’ হতে পারলেও এখনো ‘বড় ভাই’ হতে পেরেছে বলা যাবে না। প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সেই প্রচেষ্টার অন্যতম হচ্ছে কালাদান প্রকল্প।
কী আছে ‘কালাদান’ প্রকল্পে
ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ শিলিগুড়ি করিডর। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা এই করিডরটি মাত্র ৬০ কিলোমিটার লম্বা এবং প্রস্থে ২২ কিলোমিটার। চীনের ডোকলাম থেকে এই করিডরের দূরত্ব মোটে ১৩০ কিলোমিটার। চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিরাট উদ্বেগে থাকা ভারত সেভেন সিস্টার্সে যাওয়ার একটি বিকল্প পথের সন্ধান সব সময় করে এসেছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বঙ্গোপসাগর ও মিয়ানমারের কালাদান নদীপথে সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য প্রথমবারের মতো একটি ট্রানজিট প্রকল্পের প্রস্তাব করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তথ্য উপদেষ্টা (১৯৬৬-৬৯) প্রয়াত সাংবাদিক বুবলি জর্জ ভার্গেস। বি জি ভার্গেস নামে পরিচিত এই সাংবাদিক হিন্দুস্তান টাইমস ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্প নিয়ে নানা ভাবনাচিন্তা, কখনো কিছুটা এগোনো, কখনো কিছুটা পেছানোর পর ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এই প্রকল্প স্বাক্ষর করে ভারত। ‘কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’ নামে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২ বছর পরে ২০১০ সালে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কালাদান প্রকল্পটি মূলত কলকাতা হলদিয়া বন্দর থেকে আরাকানের সিতওয়ে (একসময়ের আকিয়াব) বন্দর পর্যন্ত ৫৩৯ কিলোমিটার সমুদ্রপথ, সিতওয়ে বন্দর থেকে কালাদান নদী বেয়ে মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহর পর্যন্ত ১৫৮ কিলোমিটার নৌপথ, সেখান থেকে মিজোরাম রাজ্যের আইজাওয়াল শহর পর্যন্ত ১৯৭ কিলোমিটার সড়কপথ। প্রকল্পের অধীনে সিতওয়েতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌ টার্মিনাল নির্মাণ করছে ভারত। বিপুল ব্যয়ের প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে কলকাতা থেকে আইজাওয়াল পৌঁছাতে মাত্র ৮৯৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
বর্তমানে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি করিডর দিয়ে মিজোরামের আইজাওয়ালে পৌঁছাতে ১ হাজার ৮৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য ভারতের। অর্থাৎ ১৩ বছর লাগছে কাজটি শেষ করতে।
ভারত মনে করে, কালাদান প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আসবে। অবস্থান সুসংহত হবে বঙ্গোপসাগরে। একই সঙ্গে ভারত জোরেশোরে পৌঁছে যাবে চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওসসহ পুরো পূর্ব এশিয়ায়। ভবিষ্যতে ভারত এই প্রকল্পটিতে মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের সঙ্গে ত্রিদেশীয় হাইওয়ের সঙ্গেও যুক্ত করতে চায়, যা ভারতের উচ্চাভিলাষী ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির একটি অংশ।
সীমান্ত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে আদৌ
দুই দেশেরই সীমান্তে ক্রিয়াশীল রয়েছে একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী। ওই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম ইনডিপেনডেন্ট (উলফা আই), ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড (এনএসসিএন) ও আরাকান আর্মির মতো সংগঠন। উলফা আই এবং এনএসসিএন যেমন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বসে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতায় লিপ্ত, তেমনি আরাকান আর্মিও ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়ে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
এটা ঠিক যে কেবল বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী নয়, সীমান্তের দুই পারের সাধারণ মানুষের মধ্যেও সম্প্রদায়গত আত্মীয়তা ও যোগাযোগ রয়েছে। যেমন মিয়ানমারের শিন রাজ্যের গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিজোরামের মিজোদের সম্প্রদায়গত নৈকট্য রয়েছে। আবার নাগারা রয়েছে সীমান্তের দুই পাশেই। ওই সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ চুক্তির আওতায় ভিসা ছাড়াই এপারের মানুষ ওপারের ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে এবং ১৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। মিয়ানমারের মানুষ কাজ ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিয়মিত ভারতে আসেন। এই সীমান্তের বেশির ভাগ স্থানেই কাঁটাতারের বেড়া নেই। যদিও করোনার কারণে ওই চুক্তি এখন স্থগিত আছে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের জেনারেলদের সম্পর্ক গভীর হওয়ায় আরাকান আর্মি সেই অর্থে ভারতের অভ্যন্তরে কখনোই রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে দাঁড়াতে পারেনি। ২০০৯ সালে তরুণ ছাত্রনেতা থোয়াই ম্রা নাইং মাত্র ২৯ জন সদস্য নিয়ে আরাকান আর্মি গঠন করেন। বর্তমানে তাদের সক্রিয় যোদ্ধার সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লিগ ফর আরাকান (ইউএলএ)। পুরো রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি বেশ জনপ্রিয়। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের প্রতি স্থানীয় আরাকানিদেরও সমর্থন রয়েছে। বর্তমানে অবশ্য তারা ‘অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি’তে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, এই আরাকান আর্মি হলো পূর্বতন ন্যাশনাল ইউনিটি পার্টি অব আরাকানের (এনইউপিএ) অনুসারী। ১৯৯৮ সালে ভারতীয় সেনারা আন্দামানে এই এনইউপিএর ৭ জন শীর্ষ নেতা ও ৫০ জন বিদ্রোহীকে আটক করে। হত্যা করা হয় ৭ নেতাকে, আর বন্দী করা হয় ৩৪ জন বিদ্রোহীকে। ভারতের কর্নেল ভি জে এস গ্রিওয়ালের নেতৃত্বে ওই অপারেশনের পর এনইউপিএ এবং তাদের রোহিঙ্গা সহযোগী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
আরাকান আর্মি গঠিত হওয়ার পর পরবর্তী পাঁচ থেকে ছয় বছর সংগঠনটি ভারতীয় স্বার্থে আক্রমণ করেনি বলা যায়। ২০১৫ সাল থেকে ভারত ও মিয়ানমারের সেনারা আরাকান আর্মির ওপর একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকে। মিয়ানমার সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সেনারা ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মিজোরামে আরাকান আর্মির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে সব ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। একই সময়ে ভারত সরকারের অনুরোধে মিয়ানমারের সেনারা সাগাইং প্রদেশে ভারতের নাগা, মিজো ও অসমিয়া বিদ্রোহীদের ওপর চরম আক্রমণ জোরদার করে।
তাৎক্ষণিকভাবে আরাকান আর্মি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে আরাকানে কালাদান প্রকল্পের পাঁচজন ভারতীয় কর্মীকে তারা অপহরণ করে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের কর দিতে হবে বলে জানিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের কিয়াকফুতে চীনের কোনো প্রকল্পে আরাকান আর্মি কখনো বাধা দেয় না। কারণ, মিয়ানমার সরকারের প্রতি চীনের যেমন একনিষ্ঠ সমর্থন রয়েছে, তেমনি দেশটি আরাকান আর্মি ছাড়াও মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বৃহৎ এথনিক আর্মি ‘দ্য ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির মতো সশস্ত্র সংগঠনগুলোকেও সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে।
শ্রিংলার গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার যে ‘মাজেজা’
মিয়ানমার বিশ্বের মানচিত্রে এমন একটি দেশ, শত অপরাধেও যার সাত খুন মাফ। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক শাসনের অধীনে আছে দেশটি। রাস্তায় বেরিয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করলেই গুলি, এমন শক্ত অবস্থানে আছে জান্তা। হাজারের ওপরে গণতন্ত্রপন্থী কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। বন্দীদশায় আছেন অন্তত চার হাজার মানুষ। যেখানে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সু চির গণতন্ত্রপন্থী সরকারকে উৎখাত ও শত শত নেতা–কর্মীকে হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জান্তার ওপরে অবরোধ আরোপ করেছে। অথচ ভারত, চীন ও রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো সামরিক জান্তার নিষ্ঠুরতার নিন্দাটুকু করার সাহস দেখাতে পারেনি।
এ অবস্থায় হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার মিয়ানমারে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষা কিছুটা ব্যতিক্রম বৈকি।
দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনা করতে গেলে একটু পেছনে ফেরার প্রয়োজন রয়েছে। স্বাধীনতার পর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হিসেবে দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে মিয়ানমার নীরব ভূমিকা পালন করে। পরবর্তী দুই দশক দেশ দুটির সম্পর্ক ছিল ‘না ভালো না মন্দ’।
১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থী নেতা-কর্মীদের ওপর চরম দমন–পীড়ন চালায় জান্তা। সে সময় ভারতে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকার ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের সামরিক শাসনকে বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর একটি আঘাত হিসেবে উল্লেখ করে। পরের বছর মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের জন্য ভারত তাঁর সীমান্ত খুলে দেয়। এর পরের বছর (১৯৯০) দুই আলোচিত ছাত্রনেতাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় ভারত। ১৯৯২ সালে সামরিক জান্তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবে ভারত স্বাক্ষর করে। এর পরের বছরগুলোতেও জান্তার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ভারত নীরব থাকেনি।
তবে ভারতের এই নীতি পরিবর্তন হয় ৯০ দশকের শেষের দিকে। ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। দলটি সামরিক জান্তার সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখায়। কারণ, নয়াদিল্লি বুঝতে পারে, আগামী বছরগুলোতেও সামরিক জান্তা মিয়ানমারে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে রয়ে যাবে। ১৯৯৮ সালে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নেন। এরপর ভারতের সব সরকারই মিয়ানমারের জান্তাদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক নিয়ে এগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সব সময় গুরুত্ব পেয়েছে ভারতের স্বার্থ। এ কারণেই ২০০৭ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে (স্যাফরন রেভলু৵শন) জান্তার গুলিবর্ষণের ঘটনায় সরকার টুঁ শব্দটি করেনি। ২০১৬-১৭ সালে উত্তর রাখাইনে সংঘর্ষ মোকাবিলায় সু চির ভূমিকা এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি মিয়ানমার সরকারের আচরণেও বিজেপি সরকার একপ্রকার নীরব ছিল। এমনকি গত বছরের মার্চে গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর জান্তার চরম নিষ্ঠুরতার সময়ও নেপিডোয় ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবসের প্যারেডে’ ভারত অংশ নিয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ভারত যতই মুখে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলুক না কেন, বাস্তবে তাদের জান্তা সরকারের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। কারণ, মিয়ানমারের ওপর এই অঞ্চলে তাদের প্রধান ‘শত্রু’ চীনের প্রভাব অতিমাত্রায় বেশি। ভারতের গবেষণা সংস্থা ‘মন্ত্র’ এর পরিচালক বিভু রোথরে তাঁর ‘ইন্ডিয়া–মিয়ানমার রিলেশনস: ট্রায়াম্ফ অব প্রাগমেটিজম’ শিরোনামে লেখায় মত দিয়েছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার লেন্স দিয়ে দেখতে হবে, বুঝতে হবে। মিয়ানমারকে পুরোপুরি চীনের হাতে ছেড়ে দিলে তা পরিণামে ভারতের জন্য বড় ধরনের নিরাপত্তা উদ্বেগ ডেকে আনবে। তাই সামরিক বা বেসামরিক, মিয়ানমারে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বিনিয়োগ রক্ষায় সেই সরকারের সঙ্গেই ভারতকে সমঝোতা করে চলতে হবে।
এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো মিয়ানমারই বরং ভারতকে চাপে রাখবে। ভারতের অনেক প্রস্তাবই নাকচ করে দেবে। সু চির সঙ্গে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাক্ষাৎ না হওয়াটা এর তাজা উদাহরণ।