চীনকে কেন ভয় করছে অস্ট্রেলিয়া
চলতি দশকে অস্ট্রেলিয়ার সাথে চীনের সম্পর্র্ক বলতে গেলে তলানিতে। অস্ট্রেলিয়া দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে চীনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। চীনের উত্থান অস্ট্রেলিয়ার জন্য আসলেই অশুভ হচ্ছে কিনা সেটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার চিন্তাবিদরা অস্থির। বিশেষ করে চীনবিরোধী জোট কোয়াডে অংশগ্রহণ করে অস্ট্রেলিয়া যেন বেকায়দায় পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত রয়েছে অনেক দূরে, জাপানও কম দূরত্বে নয়। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন যদি আগ্রাসী তৎপরতা চালায় সেটি অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতির ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করবে। ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভিড ব্রোফির একটি বই বেরিয়েছে ‘চায়না প্যানিক’ নামে, বইটি উভয় দেশে অনেক উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। ব্রোফি সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কাজ করেন। শক্তিশালী চীনের সাথে কিভাবে সম্পর্ক রাখতে হবে সেসব কথা বলেন। তবে তার প্রস্তাবগুলো কতটুকু জুতসই সেসব নিয়ে বিশ্লেষকরা শঙ্কিত।
মি: ব্রোফি চীন আলোচনায় উইঘুর জাতীয়তাবাদকে নিয়ে এসেছেন, চীনা-অস্ট্রেলিয়ানদের সমাজব্যবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন, মানবাধিকারের কথা বলেছেন কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ওপর নির্মম আচরণের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার শাসক শ্রেণীর আচরণ নিয়ে কথা বলেননি। ওয়াশিংটনের কাছে অস্ট্রেলিয়া ‘এশিয়ার পিভট’, কেন্দ্রবিন্দু। মার্কিনিরা বেইজিংয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাথে বাণিজ্যিক সুবিধাও আদায় করার চেষ্টা করবে। সেটি নির্ভর করে চীন কতটুকু ছাড় দিবে তার ওপর।
অস্ট্রেলীয় সরকার ২০১৭ সালে চীনের সাথে সঙ্ঘাতের দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে মোড় নেয় যদিও কোনো লড়াই চলমান বাণিজ্য উত্তেজনাকে আরো উসকে দিতে পারে। দক্ষিণ চীন সাগরে ক্ষমতা ও শক্তি দেখানোর আর একটি দিক হলো ড্রেজিংকৃত আইল্যান্ড বানানো। এখানে এক সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ ও প্রবাল দ্বীপ ছিল, বর্তমানে সেটি চীনের বিমান ও নৌঘাঁটির কাজ করছে। এই দ্বীপে চীন কয়েকটি বড় বড় রানওয়ে বানিয়েছে, যাতে ফাইটার জেট, বোম্বার, দূরপাল্লার পরিবহন বিমান উঠানামা করতে পারে। বসানো হয়েছে অসংখ্য মিসাইল ব্যাটারি, বিমানের হ্যাঙ্গার, ব্যারাক, প্রশিক্ষণ গ্রাউন্ড, রাডার সাইট। এসব প্রকারান্তে বুঝিয়ে দেয় যে, চীনের নৌবাহিনীর দ্বিতীয় স্থায়ী বসত দক্ষিণ চীনসাগর। এখান থেকে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার কিছু শেখার আছে বৈকি।
এই পদক্ষেপের কারণ হলো- অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রচুর আমেরিকান সৈন্য এবং গোয়েন্দাদের উপস্থিতি। অস্ট্রেলিয়ার ভঙ্গি এমন হওয়া উচিত যা এই অঞ্চলে উত্তেজনা হ্রাস করবে, দক্ষিণ চীন সাগরের মতো ফ্ল্যাশপয়েন্টগুলোকে অসামরিকীকরণ করবে। দুর্ভাগ্যবশত দক্ষিণ চীন সাগরকে নিয়ে বিভিন্ন সামরিক চুক্তি এবং সাগর মারাত্মক অস্ত্রের ডিপোতে পরিণত হওয়ায় অস্ট্রেলিয়াকে মারমুখী অবস্থানে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
চীনের সাথে উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য অস্ট্রেলিয়ার সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল সমর্থনদ্বারা চালিত নাকি এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব উচ্চাকাক্সক্ষা দ্বারা চালিত ছিল, সেটি পরবর্তী ঘটনাগুলো প্রমাণিত করবে। মার্কিন-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল যাই হোক না কেন, সার্বভৌম দেশগুলো অস্ট্রেলিয়ার ‘বাড়ির উঠোনে’ নিজেদের সুবিধা খুঁজে পেলে তারা ভবিষ্যতে চীনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে।
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বর্ধিত ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপটে, চীনে মানবাধিকার সম্পর্কে আলোচনা-বিশেষ করে জিনজিয়াং-এ উইঘুরদের গণবন্দী করা প্রসঙ্গ এবং হংকংয়ে গণতন্ত্র বজায় রাখা বা সেখান থেকে বেরিয়ে আসার মতো বিষয়গুলো মিডিয়াতে রঙিন করে প্রচার পেয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, মানবাধিকারের ওপর চীনকে চাপ দেয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করা। বিপরীতে বলতে গেলে, মার্কিন যুদ্ধবাজদের সংযত করার একমাত্র উপায় হলো, চীনকে সমর্থন করা।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সর্পিল-নিম্নমুখী হলেও চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে, কিছু অস্ট্রেলীয় ব্যবসায়ী চীনের বাজারে তাদের উপস্থিতি প্রচারের সুযোগ হাতছাড়া করেনি। চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্ট এক্সপোতে যোগ দেয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ান রাজ্যসরকার ভিক্টোরিয়া ভিত্তিক কয়েক ডজন কোম্পানির জন্য অর্থ প্রদান করেছে। ভিক্টোরিয়া সরকার বলেছে, বিশ্বের বৃহত্তম আমদানি মেলাতে উপস্থিতি তাদের ব্যবসাকে বিশ্বের বৃহত্তর বাজারের সাথে সংযুক্ত করতে সহায়তা করবে; নতুন চুক্তি সুরক্ষিত করতে এবং রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়ক হবে। ভিক্টোরিয়া রাজ্যের এই পদক্ষেপ চীনা বাজারের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। অস্ট্রেলীয় ফেডারেল সরকার স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে চীন থেকে দূরের দেশগুলোতে গিয়ে বৈচিত্র্য আনতে উৎসাহিত করছে। তথাপি অস্ট্রেলীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অনেকেই বিশ্বাস করে যে, চীনা বাজারের সম্ভাবনা অন্য কোনো অর্থনীতির সাথে তুলনাকরা যায় না।
অস্ট্রেলীয় ব্যবসায়ীরা বিশাল বাজারে তাদের চীনা গ্রাহকদের সাথে পুনরায় জড়িত হওয়ার উপায় অনুসন্ধান করছে। এটি চীনের জন্য বিশ্বের কাছে তার শক্তিশালী ক্রয়ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি ‘উইন্ডো’কে প্রতিনিধিত্ব করে।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি সত্ত্বেও চীন-অস্ট্রেলিয়া অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে সুযোগের কোনো অভাব নেই। চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক পরিপূরকতা দু’টি প্রাকৃতিক বাণিজ্যিক অংশীদার তৈরি করেছে।
চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে মোট বাণিজ্য চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১৯৩.৬৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, বছরে ৩৮.৪ শতাংশ এবং চীনের রেকর্ড করা সামগ্রিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির চেয়ে বেশি; চীনা কাস্টমস থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
আঞ্চলিক কমপ্রিহেনসিভ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, আরসিইপি, জানুয়ারি ২০২২ সালে কার্যকর হচ্ছে এবং যে দেশগুলো আরসিইপি অনুমোদন করেছে তম্মধ্যে চীন এবং অস্ট্রেলিয়া অন্তর্ভুক্ত। এটি বাণিজ্য সম্প্রসারণের একটি বড় সুযোগ, নতুন এক জানালা। টেনশন কমানোর বলও চীন এখানে খেলে দিতে পারে। যেমনটি ভারতের সাথে ইরানের চাবাহার নিয়ে হয়েছিল, ভারতকে বিদায় নিতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সাথে হয়েছে হাম্বানটোটা বন্দর নিয়ে যেখানে ভারত পিছু হটেছে। এমনটি হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরসিইপিতে চীন ‘বাউন্ডারি শট’ খেলতে পারে। এ সব সুযোগ নষ্ট হতে পারে যদি অস্ট্রেলিয়া এই সত্যের মুখোমুখি হতে না পারে যে, ক্যানবেরাই চীনের সাথে তার সম্পর্ককে কূটনৈতিক খাদে ফেলেছে। যদি অস্ট্রেলিয়া বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়।
গত এক বছরে মরিসন সরকার প্রতিটি ফ্রন্টে চীনের সাথে শত্রুতা বাড়িয়েছে। ভিক্টোরিয়া রাজ্য স্বাক্ষরিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চুক্তি বাতিল করেছে। অস্ট্রেলীয় রাজনীতিবিদরা বারবার হংকং, জিনজিয়াং এবং তাইওয়ানের মতো চীনের মূল স্বার্থ নিয়ে উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, বিবৃতি দিয়েছে। তারা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনকে লক্ষ করে সামরিক উত্তেজনাও বাড়িয়েছে। পশ্চিমা শক্তি প্ররোচিত পারমাণবিক সাবমেরিন কিনে চীনে আক্রমণ চালানোর টোপ গিলেছে। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো যুদ্ধ চীন সাগরে হলে অস্ট্রেলিয়াকে অবশ্যই ফ্রন্ট লাইন সামাল দিতে হবে।
অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী মরিসনের পদক্ষেপগুলো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তুলেছে এবং বাজারব্যবস্থার আস্থাকে কঠিন আঘাত করেছে। অস্ট্রেলিয়া অতীত থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি।
যদি অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে এবং চীনকে চাপ দিতে তাইওয়ানের মতো চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য দল গঠন করে, মার্কিনিদের জোটে সংযুক্ত হয়, তাহলে দেশটির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় কীভাবে উন্নতি করতে সক্ষম হবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়াকে তার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বরে সাড়া দিতে হবে এবং শীতল যুদ্ধের মানসিকতা, আদর্শগত পক্ষপাতিত্ব পরিত্যাগ করে চীনবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিতে হবে নতুবা দেশটি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ হারাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই গুরুত্বপূর্ণ মিত্র অস্ট্রেলিয়া ও জাপান তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি করে আরো আগ্রাসী সামরিক নীতি গ্রহণ করেছে। এশিয়া-প্যাসিফিকে চীনের দ্রুত সামরিক সম্প্রসারণ মোকাবেলায় তাদের এই পদক্ষেপ। অস্ট্রেলিয়া আগামী দশকে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ৪০ ভাগ বাড়াচ্ছে। এতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন কোভিড-১৯ এর দোহাই দিয়ে বাজেট বাড়াচ্ছেন। একজন মিথ্যাবাদী বলে রাজনৈতিক মহলে তিনি দুর্নাম কুড়িয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথেও জোট করেছে অস্ট্রেলিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া প্রতিরক্ষা খাতে ৭০ কোটিরও বেশি মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ১৩ ডিসেম্বর ২০২১। মরিসন বলেন, নতুন চুক্তির ফলে অস্ট্রেলিয়ার ৩০০ লোকের নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার অস্ট্রেলিয়া। গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, দেশে মার্কিন সৈন্য মোতায়েন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ক্রয়ে প্রথম কাতারে রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান ও ভারত সীমান্তে চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক সজ্জায় অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, চীন তার সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের সীমা কমিয়ে এনে সহজ ও দ্রুত আক্রমণ কৌশলের ব্যুহ সাজিয়েছে। ফলে যুদ্ধের শঙ্কাও বেড়ে গেছে বলে বিরোধী জোট মনে করছে।
অস্ট্রেলিয়া এ কারণে দৃঢ়তার সাথে তার সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করছে, অত্যাধুনিক পরমাণু সাবমেরিনের অর্ডার পাকা করেছে, প্রথম ব্যাচ আমেরিকান স্টিলথ জেট নিয়েছে, স্টিলথ দূরপাল্লার জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, ফলে অস্ট্রেলিয়ার ‘হারপুন’ ক্ষেপণাস্ত্রের তিনগুণ দূরত্বে, ৩৭০ কিলোমিটার দূরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটে আঘাত করে সেগুলো ডুবিয়ে দিতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। আধুনিক রণতরী বাড়াচ্ছে। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই প্রতিরক্ষা তহবিলের একটি বড় অংশ যাচ্ছে নৌবাহিনীর পেছনে।
জাপান সবসময়ই আগ্রাসীদের থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে থেকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাপান শান্তিবাদী থাকার যে চেষ্টা করে আসছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তার অবসান ঘটছে পুরোপুরি। এখন তারা প্রথমে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করেছে। জাপানের সামরিক বাজেট বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্টিলথ এফ-৩৫ জঙ্গি বিমান ও আগাম সতর্কতা বিমান কিনছে। জাপান কেবল চীনের উত্থান নয়, উত্তর কোরিয়াকে নিয়েও শঙ্কিত। উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা আবার শুরু করতে থাকায় জাপান এখন শত শত কিলোমিটার দূরের টার্গেটে আঘাত হানার সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। বিগত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে চেয়েছিলেন লড়াই যাতে জাপানি উপকূল থেকে দূরে হয়। এটি আবে ডকট্রিন। চীন জবাবে বলেছে, তার উল্টোটাই বরং ঘটবে। প্রয়োজনে খুব কাছ থেকেই জাপানে নিখুঁত হামলা চালাতে সক্ষম চীনা নৌবাহিনী। জাপান ইতোমধ্যেই তার প্রতিরক্ষা বাহিনীর শক্তি বাড়িয়েছে। এর হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ইজুমোকে সংস্কার করে স্টিলথ এফ-৩৫বি জেটের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এবং পরমাণুবাহী রনতরীও তৈরি শুরু করেছে। জাপানের শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী কিছু দিনের মধ্যে ভাসাবে।
যুক্তরাষ্ট্র মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করতে চাইলেও এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের কেউই মার্কিন এসব ক্ষেপণাস্ত্র তাদের মাটিতে রাখতে আগ্রহী হয়নি। তারা চীনা সামরিক সম্প্রসারণ নিয়ে উদ্বেগে থাকলেও এই অস্ত্র তাদের জন্য নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছে। ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত একটি নৌ ও লজিস্টিক্যাল সহযোগিতা প্রতিরক্ষা চুক্তিতে সই করেছে। প্রয়োজনের সময় সেটি কতটুকু কাজে আসবে, তা এক প্রশ্ন। জাপান চায় ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও আসিয়ানের বিভিন্ন দেশের সাথে তার সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করতে। তার ধারণা, এসব দেশের সহযোগিতায় তার পক্ষে চীনকে মোকাবেলা করা আরো সহজ হবে। অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, এ ধরনের আক্রমণাত্মক সামরিক অবস্থানের ফলে চীন তার আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বাড়াতেই উৎসাহিত হবে। চীন নিঃসন্দেহে আগ্রাসী প্রতিবেশীদের প্রতিরোধ করতে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করবে।
কূটনীতি কী, তা ব্যাখ্যা না করে কূটনীতি কী নয় তা সংজ্ঞায়িত করা অনেক সহজ। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সাম্প্রতিক সপ্তাহ গুলোতে সেটি দেখিয়ে দিয়েছেন। তার কূটনীতির ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনসাধারণের কিছু তিরস্কার এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর কাছ থেকে নিজে মোটা দাগে অভদ্র কথা শুনেছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেছেন ‘অকাস চুক্তি ফ্রান্সের জন্য খুব খারাপ খবর ছিল- শুধু ফ্রান্সের জন্য নয়, আমি মনে করি এটি অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য খুব খারাপ খবর এবং অস্ট্রেলীয়দের সাথে অংশীদারদের আস্থার জন্যও খুব খারাপ খবর।’
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ম্যাক্রোঁকে বলেছেন, ‘আমার ধারণা ছিল, ফ্রান্সকে অনেক আগেই জানানো হয়েছিল যে, চুক্তিটি হচ্ছে না। আমি ঈশ্বরের প্রতি সৎ ছিলাম, জানতাম না যে আপনাকে অবহিত করা হয়নি।’ মরিসন বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ইমেজ নষ্ট করেছেন। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বাসযোগ্যতার স্তর ধরে রাখতে না পারায় আসিয়ান অস্ট্রেলিয়ার প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা হারিয়েছে। যা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা ৯০ বিলিয়ন ডলারের ফরাসি সাবমেরিন চুক্তি নয়, তা হলো অস্ট্রেলিয়ার স্থিতি, প্রভাব এবং এর ক্রিয়াকলাপ। ইউরোপের টেবিলে এবং আঞ্চলিক আসিয়ান সংগঠনগুলোতে এর আসনটি গভীরভাবে কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন যে, অস্ট্রেলিয়াকে আর বিশ্বাস করা যায় না। এই বিশ্বাসটি মূলত ফরাসি চুক্তি রদ হওয়া থেকে আসে না, বরং যেভাবে বিষয়টি পরিচালনা করা হয়েছিল তা থেকে আসে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সাংবাদিকদের সরাসরি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি না, মরিসন মিথ্যা বলেছে। আমি জানি, সে মিথ্যা বলেছে।’! অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছেন যার কথা বিশ্বাস করা যায় না। একজন নেতার পদক্ষেপ জাতির ক্রিয়াকলাপকে কতটা প্রতিফলিত করে এর উত্তর অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিতে পাওয়া যায়।
লেখক : মো: বজলুর রশীদ অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার