তদন্ত ‘বাস্তবায়নের’ অভাবেই বাড়ছে নৌ দুর্ঘটনা
প্রবাদে আছে, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের নৌ-পথগুলোতে প্রায় প্রতিবছরই ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলো কি দেশের জনগণের কপালের লিখন? যদি তা-ই হয়, তাহলে তা খণ্ডনীয় নয়। কারণ ওই যে, ‘কপালের লিখন না যায় খণ্ডন’। আবার এসব দুর্ঘটনাগুলোকে এদেশের প্রেক্ষিতে না দেখে যদি উন্নত দেশের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে উন্নত দেশে লঞ্চডুবি বা নৌ-দুর্ঘটনার হার এ দেশের তুলনায় অনেক কম।
দেশে একের পর এক নৌ-দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও কোনোটির তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়, আবার কোনটির পাওয়া যায় না। অন্যদিকে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও সুপারিশ বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না। এসব নৌ-দুর্ঘটনার পর হওয়া মামলার নিষ্পত্তিও হতে দেখা যায় না। ফলে দেশে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে, বাড়ছে মৃত্যু। ঝালকাঠিতে লঞ্চে আগুনের ঘটনার পর দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞরা এসব মন্তব্য করেছেন।
২০২০ সালে বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে ১২টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাতে মারা গেছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ মুজিবুল হক মুনির সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চ ডুবির বড় ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে মেঘনা নদীতে। ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত এসব নৌ-দুর্ঘটনায় দেশে পাঁচ শ’র বেশি মামলা চলছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র একটি মামলার বিচার হওয়ার নজির রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৬ বছরে ৩ হাজার ৫৫১টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩১১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের পুকুর, ডোবা, খাল-বিল, হাওর ও নদীপথে এসব নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ নৌ-দুর্ঘটনাই সীমাবদ্ধ থাকে তদন্ত ও প্রতিবেদন দাখিলের মধ্যে। তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে উল্লেখ করা সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রেই নেয়া হয় না কার্যকর কোন পদক্ষেপ। এছাড়া যান চালনায় নিয়ম না মানা এবং অদক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে লঞ্চ বা ফেরি পরিচালনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্য পরিবহনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এবং যান্ত্রিক ত্রæটি এমন নানা কারণে নৌ-পথে বড় বড় দুর্ঘটনাও ঘটে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্র-এআরআইর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু নৌ-রুটেই দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৪টি। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৫৮ জনের আর আহত হয়েছেন ৮৮ জন। এছাড়া সড়ক, নৌ ও রেলপথে ঘটা ৩ হাজার ১৮২টি দুর্ঘটনায় মোট প্রাণহানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৩৮ জনের। আহত হয়েছেন ৪ হাজার ১৯ জন।
এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান জানিয়েছেন, শুধু নৌ-দুর্ঘটনা নয়- যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনের কার্যকর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। দুর্ঘটনার পর তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব সুপারিশ করা হয়, সেগুলোরও বাস্তবায়ন হয় না।
অন্যদিকে তদন্ত কমিটিগুলোর অনেকে রিপোর্ট দেন, আবার অনেকেই হয়তো দেননি। তবে জমা দেওয়া রিপোর্টে সবসময় সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। সেগুলো যদি সঠিক সময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হতো, তাহলেও দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক কমিয়ে আনা যেত।
নৌ- পরিবহন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক একেএম শফিউল্লাহ বলেছেন, যে কোন দুর্ঘটনার পর শুধু চালককে দোষারোপ করা হয়। অথচ দুর্ঘটনাটি কেন ঘটলো তার কারণ খোঁজার ব্যাপারে মনযোগ কম পরিলক্ষিত হয়। তিনি মনে করেন এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।
তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব সুপারিশ করা হয়, সেগুলোর বাস্তবায়ন করা জরুরি। নৌযান মালিকসহ অভিযুক্তরা যত প্রভাবশালীই সংশ্লিষ্টদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, নৌযান মালিকদের অধিক মুনাফার লোভ এবং অব্যবস্থাপনা কাটিয়ে উঠতে না পারলে এসব রোধ করা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শফিকুর রহমান বলেছেন, দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ৪৩ শতাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্য নৌ-যানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে। লঞ্চ দুর্ঘটনার দ্বিতীয় প্রধান কারণ অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন। মোট দুর্ঘটনার ২৫ শতাংশ ঘটেছে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণে।
অন্যদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৩ শতাংশ, আগুন ও বিস্ফোরণের কারণে ৬ শতাংশ এবং বাকি ৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে লঞ্চের তলা ফেটে গিয়ে। এসবের বাইরে মানবসৃষ্ট ভুল, নৌরুট ও বন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, যাত্রীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাবের কারণেও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ বছরে নৌ-দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে ছোট-বড় নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে ১ হাজার ২৩ জনের। ২০২০ সালে সারা দেশে ঘটা ১,২০৩টি নৌ দুর্ঘটনায় ডুবুরি কল পায় ফায়ার সার্ভিস। এসব দুর্ঘটনায় ৯৫৩ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে পুরুষ ৭২৪ জন এবং মহিলা ২২৯ জন। আহত হন ২৫৬ জন পুরুষ এবং ৬৮ জন মহিলা। এই বছর শুধু ঢাকা বিভাগে মারা যান ৩১৫ জন।
এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১২৬ জন, রাজশাহীতে ৮৯ জন, খুলনায় ২৮ জন, বরিশালে ৪২ জন, সিলেটে ৪১ জন, রংপুরে ১০০ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ২১২ জন মারা যান।
২০১৯ সালে মোট ৮২০টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৬৮৫ জন মারা যান, উদ্ধার করা হয় ৬৬৮ জনকে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৫০ জন, চট্টগ্রামে ৯২ জন, রাজশাহীতে ৫৬ জন, খুলনায় ৫৭ জন, বরিশালে ৩২ জন, সিলেটে ৫৫ জন, রংপুরে ৬৬ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৭৭ জন মারা যান।
২০১৮ সালে মোট ৫০৮টি নৌ-দুর্ঘটনার তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এসব দুর্ঘটনায় ৪২৬ জন মারা যান, উদ্ধার করা হয় ৪৫৫ জনকে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১২১ জন, চট্টগ্রামে ৮৭ জন, রাজশাহীতে ৩৮ জন, খুলনায় ৩৮ জন, বরিশালে ১৭ জন, সিলেটে ৩৯ জন, রংপুরে ৪৬ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪০ জন মারা যান।
২০১৭ সালে ৫৩০টি নৌ-দুর্ঘটনায় মারা যান ৬৪৩ জন, উদ্ধার করা হয় ৫৭১ জনকে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৬২ জন, চট্টগ্রামে ৬৭ জন, রাজশাহীতে ৩৫ জন, খুলনায় ৩৪ জন, বরিশালে ৩৬ জন, সিলেটে ৪৮ জন, রংপুরে ৮০ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১৮১ জন মারা যান।
আর ২০১৬ সালে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে৪২৫টি। এতে ৪১০ জন মারা যান, উদ্ধার করা হয় ৩২১ জনকে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৭৫ জন, চট্টগ্রামে ৬২ জন, রাজশাহীতে ৩৮ জন, খুলনায় ২৮ জন, বরিশালে ৬০ জন, সিলেটে ৮ জন এবং রংপুরে ৩৯ জন মারা যান।