নিত্যপণ্যের দামে দিশেহারা মানুষ
বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। রাজধানীর খুচরা বাজার থেকে ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে পারছেন।
কিন্তু গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। চলতি বছরজুড়ে বাজারে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। এতে সব শ্রেণির মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়ছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।
সম্প্রতি ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছে ৬২ শতাংশ। পাশাপাশি পুরোপুরি কর্মহীন হয়েছেন ২৮ শতাংশ মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রকোপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় মানুষ আবারও আশার আলো দেখছেন। সবকিছু পেছনে ফেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ঠিক এমন সময় পণ্যের বাড়তি দর ক্রেতাদের ভোগান্তিতে ফেলছে।
আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ায় তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত সমন্বয় করলেও মধ্য ও নিু আয়ের মানুষদের কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের মধ্যবিত্ত ও নিু আয়ের মানুষের অবস্থা শোচনীয়। এ অবস্থা উত্তরণে খুব বেশি কিছু করার নেই। বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের আওতায় আনা গেলে ভোক্তার উপকার হবে। আর যে বা যারা অনৈতিক ভাবে পণ্যের দাম বাড়ায় তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এতে এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হবে।
রাজধানীর খুচরাবাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে বৃহস্পতিবার জানা গেছে, বাজারে সব ধরনের চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকার পরও চলতি বছরের পুরোটা সময় চালের দাম বাড়তি ছিল। পরিস্থিতি এমন যে, এক মাস চালের দাম কেজিতে ২-৩ টাকা কমলে পরের মাসে কেজিতে ৩-৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
এ দাম বৃদ্ধির পেছনে মিল মালিকদের কারসাজি ছিল। তারা বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে চালের দাম মিলপর্যায় থেকে বাড়িয়ে বিক্রি করেছেন। ফলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম সমন্বয় করতে হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে। বর্তমানে আমন মৌসুমেও যেখানে বাজারে নতুন ধানের চাল বিক্রি শুরু হয়েছে, সেখানে আবারও নতুন করে কারসাজি করে মিল মালিকরা চালের দাম বাড়িয়েছেন।
ফলে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম আবারও ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৮ টাকা। আর এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪৭ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমনের ভরা মৌসুমেও মিল মালিকদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। মিলপর্যায়ে দাম বাড়ায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে। যা অযৌক্তিক। তিনি বলেন, বছরের পুরোটা সময় মিল মালিকদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়তি ছিল। কথায় কথায় তারা নানা অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়েছেন। কিন্তু দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ আছে।
এদিকে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি ছোট আকারের মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ১১০ টাকা ছিল। আর এক মাস আগে একই দামে বিক্রি হয়েছে। মাঝারি আকারের মসুর ডাল কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১০০-১০৫ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৯৫-১০০ টাকা। অন্যদিকে ভোজ্যতেলের দামে গত দেড় বছর ধরে ক্রেতার নাভিশ্বাস উঠছে। গত বছর এ সময় পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৫৮০ টাকা, যা বৃহস্পতিবার ৭০০-৭৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া খুচরাবাজারে প্রতিকেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৪০-৪৫ টাকা।
রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন বলেন, বাজারে এলে কান্না পায়। বাড়িতে তিন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মা আমার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। মাসের বেতন পেয়ে বাজারে এলে অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ অন্যান্য খরচ করার মতো টাকা থাকে না। তিনি বলেন, বাজারে সব ধরনের পণ্য আছে, কিন্তু বিক্রেতাদের অসাধুতার কারণে দাম বেশি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের তদারকিও চোখে পড়ে না। যে কারণে বিক্রেতারা ক্রেতার পকেট কাটছে। আর এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি একেবারেই অযৌক্তিক। করোনাকালে সব শ্রেণির মানুষের আয় কমেছে। তবে ব্যয় বেড়েছে অনেক। আর এ ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি।
তাই বাজারে অসাধুদের রোধে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। প্রয়োজন হলে নতুন বছর থেকে ভোক্তার স্বার্থে বাজার ব্যবস্থাপনা নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।
রাজধানীর খুচরা বাজারে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, বৃহস্পতিবার প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬০-১৭০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৫০ টাকা। আর এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা। প্রতি হালি ফার্মের ডিম (৪ পিস) বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৩২-৩৩ টাকা। কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে মাসের ব্যবধানে আমদানি করা রসুন বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকা।