কক্সবাজারে বার বার ধর্ষণ, নিরাপত্তায় দায়ী কারা?
রাজধানী ঢাকা থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। সুরক্ষিত লাবনী পয়েন্টে স্বামী ও ৮ মাসের সন্তানসহ বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সুরক্ষিত সৈকতে এই ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। সেখান থেকেই তাকে তুলে নিয়ে একটি চায়ের দোকানের পেছনের ঝোপে নিয়ে ধর্ষণ করে তিনজন। এরপর স্বামী ও সন্তানকে জিম্মি রেখে একটি গেস্ট হাউজে নিয়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করা হয়।
এর আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একজন অস্ট্রেলীয় নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে একটি রিসোর্টের দুইজন কর্মচারী। আর ২০০৫ সালে বিদেশি এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার মধ্যে কক্সবাজারের সুরক্ষিত একটি সৈকতে এই ধরনের ঘটনাগুলো নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
কেন পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘আমরা তো দেখি, কখনও কখনও কক্সবাজারে পর্যটকদের চেয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বেশি। তারপরও কেন বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা চাই, এখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক।’
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এইচ এম হাকিম আলী বলেন, ‘গার্মেন্টস সেক্টর থেকে এখন সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা এলেও আমাদের ভবিষ্যত কিন্তু পর্যটন খাতে। উদীয়মান এই সেক্টরে এ ধরনের ঘটনাগুলো বিদেশিদের কাছে খুবই খারাপ বার্তা দিচ্ছে। সরকারের উচিৎ এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া। পর্যটন এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও বাড়ানো দরকার। ’
বাংলাদেশ রেস্তোঁরা মালিক সমিতির কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি নাঈমুল হক চৌধুরী টুটুল বলেন, ‘করোনার কারণে অনেকদিন পর্যটক ছিল না। এখন পরিস্থিতি একটু ভালো হওয়ায় পর্যটক বাড়ছে। তার মধ্যে এই ধরনের ধর্ষণের ঘটনা খুবই খারাপ সংবাদ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৈকত হওয়ার পরও নিরপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় বিদেশিরা এখানে আসতে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। আমাদের নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করা দরকার। তাহলে এই পর্যটন সেক্টরটা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।’
বাংলাদেশের ধর্ষণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বড় কারণগুলো হলো-
১. ক্ষমতার দাপট
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ তাকে ধর্ষণ করেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী৷ ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এক মাস আগে ঘটলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
২. অনিরাপদ পরিবহণ
২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আলোচিত হয়। তবে এর পরেও নারীদের জন্য গণপরিবহণ নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। গত ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে এক বাসচালককে গ্রেফতার করা হয়৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর গণপরিবহণে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
৩. নিরাপত্তাহীন সড়ক
২০২০ সালের পাঁচ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। বাস থেকে নামার পরপরই তাকে সড়কের পাশে তুলে নিয়ে যায় ধর্ষক মজনু। খোদ রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় এই ঘটনায়।
৪. শিশুরাও ধর্ষণের শিকার
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের খবর উঠে আসছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর হিসাবে ২০২০ সালে ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এই সংখ্যাটি ৯৭৪। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্য বা স্বজনরাও জড়িত।
৫. বাদ নেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক গত দুই বছর প্রতিরাতে শিশু ছাত্রদের যৌন নিপীড়নে বাধ্য করতেন বলে স্বীকার করেছেন। নভেম্বরে কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় ১১ বছরের ছাত্রকে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ১২ মার্চ রাজধানীতে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মসজিদের ইমাম গ্রেপ্তার হন। অক্টোবরে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়।
৬. দেড় হাজার নারী
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। ২০১৯ সালে ১,৪১৩ জন নারী, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১,২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে। যদিও প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও বেশি বলে মনে করা হয়।
৭. রক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে খুলনা রেলওয়ে থানায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে। একই বছর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ধর্ষণের মামলায় পুলিশের এক উপপরিদর্শককে গ্রেফতার করা হয়। এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অক্টোবরে রংপুরে পুলিশের এক এএসআইকে বরখাস্ত করা হয়।
৮. বিচারহীনতা
২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৫টি ধর্ষণ মামলা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে তারা দেখেছে প্রতিটি মামলাতেই আসামি ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছে। তিন জন অভিযুক্ত কারাগারে রয়েছেন, দুই জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় রয়েছে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের গ্রেফতার করা যায়নি। গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই তথ্য জানিয়েছে।
৯. সমাধান বিয়ে!
ধর্ষণের পর সালিশ বা আদালতের মাধ্যমে সমাধান হিসেবে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে। ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়। একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে। ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়।
১০. দায় পোশাকের?
ধর্ষণের হাত থেকে শিশু, বৃদ্ধ নিস্তার পাচ্ছেন না কেউ। বাদ নেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই। তবুও এই প্রবণতার জন্য কেউ কেউ নারীর পোশাককে কটাক্ষ করেন। ধর্ষণের জন্য ‘অশালীন পোশাককে’ দায়ী করে এক ভিডিও বার্তা দিয়ে সমালোচিত হন চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল। নভেম্বরে সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিলের আলোচনায় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে বক্তব্য দেন।