ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মধ্যেও রয়েছে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও আস্থার সংকট।

0

আসন্ন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম’র মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসি’র এই ঘোষণার পর ইভিএম নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিতর্ক শুধু রাজনৈতিক মহলেই সীমাবদ্ধ নয়, ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মধ্যেও রয়েছে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও আস্থার সংকট। এই আস্থার সংকট পরিলক্ষিত হয় ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’ পরিচালিত এক অনলাইন জরিপের ফলাফলে। সুজনের ওয়বসাইটে পরিচালিত এক জরিপে ১,৪০০ জন অংশ নেন। যার ৯১ শতাংশই আসন্ন সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেন।

ইভিএম ব্যবহারের ওপর আস্থার সংকটের মোটাদাগে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বর্তমান নির্বাচন কমিশন এবং যে প্রক্রিয়ায় কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদসহ কতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করেছে তার ওপর অনাস্থা।

দ্বিতীয়ত, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন যে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা নিচ্ছে তার ওপর অনাস্থা।

নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সংকটের মূল কারণ হলো স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে তাদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। আমাদের নির্বাচনী আইনের প্রায় সবগুলোই বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লঙ্ঘিত হয়েছে। এতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাসহ আরও অনেকেই জড়িত ছিলেন। কিন্তু কমিশন কারো বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। একাদশ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ফলাফলেও দেখা যায় নানা অসঙ্গতি। প্রাথমিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়: (১) ১০৩টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, যা অবাস্তব, অসম্ভব ও অকল্পনীয়। (২) ১,১৮৫টি কেন্দ্রে প্রধান বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা শূন্য ভোট পেয়েছেন এবং আওয়ামী লীগ দুটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছে, যা কল্পনাতীত। (৩) ৫৮৬টি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এবং অন্য একটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থী শতভাগ ভোট পেয়েছেন, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের ওপর অনাস্থার আরেকটি কারণ হলো নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমের ব্যবহার করা হয়। বাকি ২৯৪টি আসনে ব্যালট পেপার ব্যবহার করা হয়। ইভিএমে ভোট পড়ার হার ছিল ৫১.৪২ শতাংশ। পক্ষান্তরে অন্য ২৯৪টি আসনে এ হার ছিল ৮০.৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ইভিএমের তুলনায় ব্যালট পেপার ব্যবহৃত আসনসমূহের ভোটের হার ছিল ২৯.৩৮ শতাংশ বেশি। তাই কোনটি ভোট পড়ার সঠিক হার? ইভিএমের? না ব্যালটের? একই নির্বাচনে দুটি হার কোনোভাবেই সঠিক হতে পারে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এই ব্যাপারে জাতির কাছে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। অথচ এর সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে। যেমন, যদি পেপার ব্যালটে ভোট পড়ার হার সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে ইভিএম ব্যবহারের কারণে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর ইভিএমকে যদি সঠিক বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে ইভিএমের চেয়ে বাকি আসনগুলোতে ৩০ শতাংশ বেশি ভোট পড়া নিশ্চয়ই কারসাজি ও কারচুপির অংশ। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে এর চেয়ে বড় কোনো কেলেঙ্কারি হতে পারে না। এর জন্য নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই দায়বদ্ধ হতে হবে, দায়বদ্ধ করতে হবে।

অন্যদিকে ইভিএমের ওপর আস্থার সংকট তৈরির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। একটি কারণ হলো ইভিএম ক্রয়ের প্রক্রিয়া। দেখা যায় প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান হওয়ার আগেই কমিশনের পক্ষ থেকে ইভিএম কেনার কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। এমনকি ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে প্রতিটি মেশিন ২ লাখ ৩২ হাজার টাকায় ইভিএম কিনেছে মর্মে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয় (প্রথম আলো, ১৫ই অক্টোবর ২০১৮)। এ ছাড়া রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই ইভিএম ব্যবহারে কমিশনের উদ্যোগ অতি উৎসাহের প্রতিফলন। যদিও দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিইসি বলেছিলেন: ‘সব দল না চাইলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না (প্রথম আলো, ২৯শে আগস্ট ২০১৮)।’ তাই রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অতি উচ্চ দামে ইভিএম কেনার কারণে কমিশনের ওপর জনগণের আস্থার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় এবং জনমনে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হয়।

আস্থার সংকটের আরেকটি কারণ হলো আমাদের ইভিএমে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিআইটি) বা ইভিএমে প্রদত্ত ভোট কাগজে রেকর্ড হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে ভোটারদের ভোট প্রদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পায় এবং ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা পরবর্তীতে নিরীক্ষার কোনো সুযোগ থাকে না। ইভিএম কেনার আগে একটি কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর উপদেষ্টা ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী। এ ছাড়া একটি সাব-কমিটি করে দেয়া হয়েছিল, যে কমিটির অনুমোদনের ভিত্তিতেই ইভিএম কেনা হয়েছিল। কিন্তু জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে মূল কমিটি তা অনুমোদন করেনি। তাদের সুপারিশ ছিল এতে ‘ভিভিপিআইটি পেপার অডিট ট্রেইল’ রাখা, যাতে সঙ্গে সঙ্গে ভোটের রেকর্ড কাগজে লিপিবদ্ধ থাকে এবং ভোটার কাকে ভোট দিয়েছে ও তার ভোট কোথায় পড়েছে তার একটি প্রিন্ট-আউট পাওয়া যায় এবং পরবর্তীতে কোনো প্রশ্ন উঠলে যাতে অডিট করা যায়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন উক্ত সুপারিশ অমান্য করে ইভিএম ক্রয় করে, যার ফলে জামিলুর রেজা চৌধুরী এতে স্বাক্ষর করেননি, যদিও কমিশন তার নাম অযাচিতভাবে ব্যবহার করেছে (প্রথম আলো, ১৫ই অক্টোবর ২০১৮)।

প্রসঙ্গত, ইভিএমে ‘ভিভিপিআইটি’ না থাকায় আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইভিএম নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এই দুর্বলতা দূর করার জন্য দিল্লি হাইকোর্টের একটি রায় অনুসরণে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২০১১ সালে তাদের ব্যবহৃত ইভিএমে ‘ভিভিপিআইটি’ সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন। সাত-আট বছর পরে নির্মিত এবং অনেক বেশি দামে কেনা ইভিএমে এ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে আমাদের নির্বাচন কমিশনের উদাসীনতাও কমিশনের প্রতি অনাস্থার আরেকটি কারণ।

আস্থার সংকটের অন্য একটি কারণ হলো ইভিএমে ভোট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল পাওয়ার কথা থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক পরে তা প্রকাশ করা হয়েছে। এর কারণ কী আমাদের জানা নেই। ইভিএমের যান্ত্রিক ত্রুটি? যান্ত্রিক ত্রুটি যদি হয় তাহলে তো এই ফলাফল কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যদি সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল ঘোষণা না করতে পারে, তাহলে পরবর্তীতে কীভাবে তা প্রকাশ করা হলো? এখানে কোনো কারসাজি হয়েছে কিনা এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে।

ইভিএম প্রযুক্তির আরেকটি সমস্যা হলো, এটি আগে থেকেই এমনভাবে ক্যালিব্রেইট/প্রস্তুত করা যেতে পারে যাতে ভোটার যে কোনো প্রার্থীকে ভোট দিলেই তা কোনো পূর্বনির্ধারিত প্রার্থীর পক্ষে রেকর্ড হয়ে যাবে। বর্তমানের উন্নত প্রযুক্তির যুগে এটি করা একেবারেই অসম্ভব নয়। বেড়ায় ক্ষেত খেলে তা হতেই পারে।

নির্বাচন কমিশনের ব্যবহার করা ইভিএমে ভোটারদের বায়োমেট্রিক্স বা আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে ভোট দিতে হয়। যদি আঙ্গুলের ছাপ মেশিন পড়তে না পারে, তাহলে নির্ধারিত নির্বাচনী কর্মকর্তা ভোটারের বায়োমেট্রিক্স ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ‘ওভাররাইড’ বা বাদ দিতে পারেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৫% ভোটারের ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তারা এ ক্ষমতা ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলেন (বিবিসি বাংলা, ২৪শে নভেম্বর ২০১৮)। ভোটার, এজেন্ট ও গণমাধ্যমের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনী কর্মকর্তা যে এ ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে দেননি, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

বিগত জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ইভিএম কেন্দ্রে ভোটাররা যখন ভোট দিতে যায় তখন অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ব্যক্তি ভোট প্রদানের গোপনীয় কক্ষে উপস্থিত থেকে ভোটারের ভোট প্রদানের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার এবং অনেক ভোটারকে ভোট প্রদান থেকে বিরত রাখার অভিযোগ উঠেছে (দি ডেইলি স্টার, ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯)।

কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আসন্ন সিটি নির্বাচনে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দুইজন ব্যক্তি ইভিএমের দায়িত্বে থাকবেন। আমাদের আশঙ্কা যে, যেহেতু কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা নেই, এর মাধ্যমে আমাদের সেনাবাহিনী বিতর্কিত হতে পারে।

আমরা মনে করি, ইভিএম নিয়ে বিতর্ক বহুলাংশে এড়ানো যেত, যদি ইভিএম নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা যেত এবং ইভিএমে ‘ভিভিপিআইটি’ যুক্ত করা হতো। ‘ভিভিপিআইটি পেপার অডিট ট্রেইল’-এর অনেক সুবিধা রয়েছে; যেমন, পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যম ও প্রার্থীর এজেন্ট এতে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই এটা একটা রক্ষাকবচ হতে পারতো।
প্রসঙ্গত, পৃথিবীর গুটিকয়েক দেশেই ইভিএম ব্যবহার করা হয়। যেসব দেশে ব্যবহার হয় না, তারা প্রযুক্তির দিক থেকে আমাদের থেকে অনেক উন্নত। যেমন, জার্মানি, নেদারল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই ইভিএম নিয়ে আমাদের কমিশনের কেন এতো উৎসাহ তা আমাদের বোধগম্য নয়।

পরিশেষে, যেহেতু অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের আস্থাহীনতা রয়েছে এবং ইভিএম নিয়েও নানান প্রশ্ন রয়েছে তাই ঐকমত্য ছাড়া আগামী যে কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com