শরীরে মারাত্বক আঘাত নিয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ঢাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়ে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ও তার সহযোগীদের অনেকেই এখনও সুস্থ হননি। শরীরে মারাত্বক আঘাত নিয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। তাদের কারো কারো মাথায় আঘাত, মেরুদন্ড ও হাতের হাড় ভাঙ্গা, চোখে রক্তজমাট, কিডনিতে সমস্যা নিয়ে যন্ত্রনাময় দিন পার করছেন। কবে সুস্থ হবেন এটি তারাও যেমন বলতে পারছেন না ঠিক তেমনি চিকিৎসকরা তাদের কোনো আশার বাণী শুনাতে পারেনি। চিকিৎসকরা বলেছেন, চিকিৎসা চলবে তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে। তাদের এমন অবস্থা নিয়ে সহপাঠিদের পাশপাশি স্বজনরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। গতকাল সরজমিন হাসপাতালে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন ভবনের তিন তলার ৩৬ নম্বর কেবিনে চিকিৎসা নিচ্ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এপিএম সোহেল। গতকাল দুপুরে ওই কেবিনে গিয়ে দেখা যায় তিনি শরীর ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন।
পাশে বসে তাকে শান্তনা দিচ্ছেন তার স্বজন ও সহপাঠিরা। কি হয়েছিলো সেদিন এবং এখন শরীরের অবস্থা কেমন জানতে চাইলেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, ঘটনার দিন ডাকসু ভবনের দ্বিতীয় তলার বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারামবোর্ড খেলছিলাম। হঠাৎ করে শুরু হয় চিৎকার-চেঁছামেচি। কিছু লোক আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিলো। এইটুকু শুধু মনে আছে। আর কিছুই মনে নাই। ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হঠাৎ আমার সেন্স আসে। তখন নার্সরা আমাকে দেখিয়ে বলছিলো এই ছেলেটার অবস্থা খুবই খারাপ ও বাঁচবে না মনে হচ্ছে। এই কথা শুনার পরপরই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আইসিইউতে নিজেকে আবিষ্কার করি। পরে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে বেধড়ক মারধর করে দুতলা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছে। দুদিন আইসিইউ ও দুদিন এইচডিইউতে থাকার পর আমাকে কেবিনে দেয়া হয়েছে। এখন ডানহাত, বাম হাতের কনুই থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত এবং দুই পা নাড়াতে পারি না। শরীরের সর্বত্র ব্যাথা। মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায় কোমর পিঠ নাড়ানো যায় না। মাথায় আঘাত পাওয়ায় ৪০টি সেলাই দেয়া হয়েছে। তাই মাথা বেশি নাড়াছড়া করা যায় না। ব্যাথার কারণে ঘুমাতে কষ্ট হয়। খাওয়া দাওয়ার রুচি ছিল না। ৪/৫ দিন ধরে অল্প অল্প খেতে পারছি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন সেরে উঠতে আরো আড়াই মাস সময় লাগবে। কবে ছাড়পত্র পাওয়া যাবে সেটা তারা জানাননি। তবে বলেছেন চিকিৎসা চলবে।
একই কেবিনে চিকিৎসা নিচ্ছেন ভিপি নুরের ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম। মাথায় মারাত্বক জখমের কারণে তিনি চোখে ঝাপসা দেখেন। উচ্চ শব্দে কথা বা অন্য কোনো শব্দ শুনলেই অস্বস্তি লাগে। আমিনুল ইসলাম বলেন, বড় ভাই নুরকে নিয়ে তার হাতের চিকিৎসার জন্য ওই দিন ঢাকা মেডিকেলে এসেছিলাম। সেখান থেকে আবার ডাকসু ভবনে যাই। তখন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা এসে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা অনেক কষ্ট করে তাদের ভবনের বাইরে ঠেলে দিয়ে গেট বন্ধ করে ডাকসু ভবনে অবস্থান নিয়েছিলাম। তারা গেইটের বাইরে অবস্থান করায় আমরা ডাকসু ভবন থেকে বের হতে পারি নাই। এর কিছুক্ষণ পরেই ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে বেশ কিছু ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ডাকসু ভবনে প্রবেশ করে। তারা এসে ভাইকে (নুর) হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলো। তখন তার আশেপাশে যারা ছিল তাদের তারা মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে তারা আমাকে মারছিলো। এসময় আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তারা ছাত্রলীগের নেতাদের বলে ওকে মেরো না ভাই। ও ভিপি নূরের ছোট ভাই। আমি সভাপতি সনজিতের পায়ে ধরে বলি আপনারা আমাকে মেরে ফেলেন তবে আমার ভাইকে ছেড়ে দেন। তখন সনজিত আমাকে বলেন, তুই যখন তোর ভাইকে বাঁচানোর জন্য এসেছিস তখন তুই আগে মর। এই কথা বলে তিনি তার হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে আমার মাথায় জোরে আঘাত করেন। আমি চোখে অন্ধকার দেখতে পাই। তখন কেউ একজন বলছিলো ওকে বাইরে ফেলে দে। এরপর আর কিছুই বলতে পারি না। দুদিন আমার কোনো সেন্স ছিল না।
আইসিইউতে দুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর আামাকে কেবিনে এনে ভর্তি করা হয়। আমার মাথার বিভিন্ন অংশে চিকিৎসকরা ৩৩টি সেলাই দিয়েছেন। এতদিন চিকিৎসা নেয়ার পরও আমি এখনও স্বাভাবিক হতে পারি নাই। ঝাঁপসা দেখি চোখে। চিকিৎসকরা বলেছেন মাথার আঘাত থেকে চোখে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া একা হাঁটতে পারি না। দুর্বল লাগে। হাতে রডের আঘাতের ব্যাথা রয়েছে। হাসপাতাল থেকে কবে ছাড়া পাবো জানিনা। নিউরো ও কিডনি বিভাগের অধীনে আমার চিকিৎসা চলছে।
মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের ৯০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের মেহেদী হাসান ও আরিফুল ইসলাম। তাদের দুজনের শরীরের অসংখ্য আঘাতে চিহ্ন। সিরাম ক্রিয়েটিন বেশি হওয়াতে কিডনি স্বাভাবিক ভাবে কাজ করছে না। তাই তাদের দুজনেরই কিডনি ডায়ালাইসিস চলছে। গতকাল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা মেহেদী হাসান বলেন, আমার মাথায় আঘাতের জন্য তিনটি সেলাই দেয়া হয়েছে। হাটু, বুকে, ঠুটে ও হাতে রড, বাশের লাটি ও পাইপের আঘাত আছে। ঘটনার দিন আমাকে গণস্বাস্থ্য হাসাপাতালে নেয়া হয়েছিলো। সেখানে দুদিন থাকার পর ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়। কয়েকদিন কেবিনে চিকিৎসা নেয়ার পর কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ে। পরে ৯০১ নম্বর ওয়ার্ডে আনা হয়। ৩০ ডিসেম্বর থেকে আমার ডায়ালাইসিসি শুরু হয়েছে। সিরাম ক্রিয়েটিন ৩ পয়েন্ট ৪০ তে আছে। যেখানে স্বাভাবিক রেঞ্জ থাকার কথা ১ পয়েন্ট ৪ এর মধ্যে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, ওই দিনের হামলায় আমার কোমর, মাথা, হাটু ও পিঠে আঘাত লাগে। এখনও এসব স্থানে প্রচুর ব্যাথা। উচ্চ রক্তচাপের পাশপাশি কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়েছে। চোখে রক্ত জমাট বেধেছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, সিরাম ক্রিয়েটিন ১ পয়েন্ট ৪ এর মধ্যে আসতে হবে। এখন সেটি সাড়ে ৬ পয়েন্টের কাছাকাছি। দুদিন আগেও সেটি ১০ পয়েন্টের উপরে ছিল। এখন পর্যন্ত তিনদিন ডায়ালাইসিস করা হয়েছে। কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে হলে আরও সময় লাগবে। চোখের রক্ত জমাট বাধা সারতে দেড় মাস সময় লাগবে। তিনি বলেন, ঘটনার পর আমাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। কিন্তু তারা আমার ভর্তি নেয়নি। পরে আমাকে নিয়ে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১দিন থাকার পর অবস্থা খারাপ দেখে সেখানকার চিকিৎসকরা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করেন। এখানে আমার চোখের চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু আমার চারদিন পায়খানা বন্ধ ছিল। কোমরে ব্যাথা বাড়তে থাকে। পেইন কিলার দেয়ার পর আরও ব্যাথা বাড়ে। পরে ২৬ তারিখ একটি পরীক্ষা করে দেখা যায় কিডনিতে সমস্যা। সিরাম ক্রিয়েটিন ১১ পয়েন্টে ছিল। পরে ডায়ালাইসিস করে কিছুটা কমিয়ে আনা হয়।
গত ২২ ডিসেম্বর ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাদের ওপর হামলা করে মুক্তিযুদ্ধমঞ্চ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলায় ভিপি নূরসহ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান, মশিউর রহমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক এপিএম সোহেল, ধানমণ্ডি চাটার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তুহিন ফারাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জসিম উদ্দিন হলের নাজমুল হাসান, আয়াত উল্লাহ বেহেশতি, সাইফুল ইসলাম, ঢাকা সিটি কলেজের মেহেদী হাসান, জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিফুল ইসলাম, ভিপি নুরের ছোট ভাই আমিনুল ইসলামসহ আরোও অনেকেই আহত হয়েছিলেন। তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা কমিউনিটি ক্লিনিক এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।