রাষ্ট্র তার নাগরিকদের রক্ষায় অনেক কিছুই করে, বলা চলে-সেই করাটাই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ, তাই তো সেই নাগরিকরা রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, তার ভেতরকার শান্তি-শৃঙ্খলা অটুট রাখতে প্রয়োজনে নিজের জান পর্যন্ত উৎসর্গ করেন।
রাষ্ট্র আরও অনেক কিছু করে থাকে তার নাগরিকদের জীবন-মান সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে। সে কারণেই শত্রু-রাষ্ট্রের যুদ্ধ-হামলার সময়ে বোমা-কামান-বন্দুকের সামনে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের জীবন দিয়ে যুদ্ধ লড়েন দেশপ্রেমিক নগরিক-হোক সে সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সদস্য, কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সীমান্তরক্ষী, কিংবা যুদ্ধকালীন স্বেচ্ছাসেবক অথবা একেবারেই আমজনতার সদস্য। সেটি অতি সহজ-সরল কথা, তা বোঝার জন্য সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট, পণ্ডিত হওয়ার দরকার পড়ে না।
এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জীবনাশঙ্কায় পড়েছেন, তিনি লিভার-সিরোসিসের মতো অত্যন্ত জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। এখানকার সবচেয়ে উন্নত প্রাইভেট হাসপাতালের উঁচুমানের ডাক্তাররা তাকে সারিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু উন্নত চিকিৎসা-সরঞ্জামাদির অভাবে আর অধিকতর চিকিৎসা-দক্ষতার সংকটে তাদের সেবা-কার্যক্রমে আর আগানো সম্ভব নয়, সেটি তারা জানিয়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২৮ নভেম্বর এ চিকিৎসক দলের প্রধান (মেডিকেল বোর্ড প্রধান) প্রফেসর ডা. এফএম সিদ্দিকী বিএনপি প্রধানের গুলশানের বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ম্যাডাম খালেদা জিয়ার লিভার সিরোসিসের কারণে বারবার রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এটি খুবই সংকটজনক পরিস্থিতি, এ অবস্থায় চিকিৎসকরা অসহায়বোধ করছেন।
তারা অবিলম্বে জার্মানি, যুক্তরাজ্য বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বিশেষায়িত হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুততম চিকিৎসা শুরুর ওপর জোর দিচ্ছেন; এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি দুই বছর ধরেই বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যাপারে আন্দোলন করে আসছে, সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, এমনকি যারা বিএনপির সঙ্গে যুক্ত নন, তাদের অনেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে বিদেশে উন্নততর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নিতে তাকে মুক্তিদানের জন্য সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করে যাচ্ছেন।
তার পরিবারের সদস্যরা সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে যাচ্ছেন। মন্ত্রীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে অনেকে তার বিদেশে চিকিৎসার পক্ষে প্রচুর লেখালেখি করছেন।
এতসব আবেদন-নিবেদনের বিপক্ষে সরকার শক্ত অবস্থান নিয়েছে-তারা কোনো অবস্থাতেই বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে দেবে না। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক বিবেচনায় তার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার বলে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব বিনীতভাবে সরকারের শীর্ষনেতার কাছে আবেদন করে যাচ্ছেন মাসের পর মাস।
মন্ত্রীদের কয়েকজন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেও ছাড়ছেন না। অথচ জিয়াউর রহমানের আমল থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে বেশকিছু বিশিষ্ট রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের জেলে থাকার পরও বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করার উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু এখন বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে অজুহাত তোলা হচ্ছে নানারকম, আইনের বিচিত্র ব্যাখ্যা দিতে ব্যস্ত আইনমন্ত্রী।
আওয়ামী লীগ শীর্ষনেতারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন-আল্লাহ-না-করুন, এ অবস্থায় কোনো মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটলে তার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে? আমাদের রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় যারা আসেন, তাদের প্রত্যেককে শপথ করতে হয়-‘কোনো অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনোকিছু করবেন না’; সেটির মানে কী? এখন যে বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি রাগান্বিত হয়ে আছেন কেউ কেউ, তা কি সরকারের শীর্য পর্যায়ের ব্যক্তি হয়ে তারা পারেন? তারা কি শপথ ভঙ্গ করছেন না?
আমাদের বিনীত প্রার্থনা-ক্ষমতাসীন নেতারা দ্রুততার সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার লক্ষ্যে উন্নত রাষ্ট্রের উপযুক্ত হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগদানের জন্য তাকে মুক্তি দেবেন।
খায়রুল কবীর খোকন : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক