ঝুঁকিতে ব্যাংক খাত সুশাসনে ঘাটতি
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর মৌলিক আয়ের উপকরণ সুদ থেকে কমেছে আয়, বেড়েছে ব্যয়। মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে।
ব্যাংকগুলোর সম্পদ বা ঋণ থেকে আয় কমেছে। বড় ঘাটতি আছে সুশাসনেও। সবমিলিয়ে করোনার প্রভাবে ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংক খাত। বিদ্যমান সমস্যা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। এমন কি কিছু ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সময়সীমাও জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এক বৈঠকে আইএমএফের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ব্যাংকিং খাতের বিষয়ে এসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছেরের নেতৃত্বে এ বৈঠকে নির্বাহী পরিচালক জোয়ার্দার ইসরাইল হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এর প্রধান রাহুল আনন্দ। দলের অন্য সদস্যরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) একটি মিশন ১০ দিনের সফরে ঢাকায় অবস্থান করছে। মিশনটি ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবে। এ সময় তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা।
এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তারা। এরই অংশ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রথম দফার বৈঠকটি রোববার অনুষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ব্যাংকগুলোর তদারকির প্রধান উপকরণ-মূলধন, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, আয়, তারল্য ও বাজার ঝুঁকি- এ ৬টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আইএমএফ নানা প্রশ্ন করে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি কিভাবে কত সময়ের মধ্যে পূরণ করা হবে-সে ব্যাপারে রোডম্যাপ জানতে চায়।
সম্পদ ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে তার কিভাবে উন্নয়ন করা হবে। ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টিও তারা তুলে আনে। ঋণ বিতরণ হচ্ছে আদায় হচ্ছে না। কিভাবে ঋণ আদায় বাড়ানো হবে-সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অ্যাকশন প্ল্যান জানতে চায়। করোনার প্রভাবে ব্যাংকগুলোর নিট আয় কমে গেছে।
তারপরও ব্যাংকগুলো পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। এপিট কিভাবে বেড়েছে সে প্রশ্নও জানতে চেয়েছে তারা। ব্যাংকিং খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। কিছু ব্যাংকের তারল্য বেশি, আবার কিছু ব্যাংকের খুবই কম। তারল্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও প্রশ্ন করেছে আইএমএফ।
এ বিষয়ে বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিভিন্ন অ্যাকশন প্ল্যানগুলো তুলে ধরেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ব্যাংকগুলোকে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
যেসব ব্যাংক তা পারবে না, তাদের বিভিন্ন খাতে নীতি সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা হবে। করোনার কারণে ঋণ আদায়ে বিশ্বব্যাপী ছাড় দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ঋণ আদায় কমেছে। তবে এটি এখন বাড়ার দিকে। মূলধন ঘাটতি রয়েছে কয়েকটি ব্যাংকের। তাদের এটি পূরণ করার সময়সীমা দেওয়া হয়েছে। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলোকে আরও দক্ষ করে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, বৈঠকে ঘুরেফিরে বারবার এসেছে উচ্চ ঋণখেলাপি ঋণের প্রসঙ্গটি। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ঝুঁকিতে পুরো ব্যাংকিং খাত। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ কীভাবে ঘটবে। কোন কৌশলে জনগণের আমানত ফেরত পাওয়া যাবে- এসব বিষয়ে আইএমএফ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের ঋণ স্থিতি ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। করোনার শুরুর বছর ২০২০-এর ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। যদিও প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি।
করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গত বছর ঋণ গ্রহীতারা কোনো টাকা পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি দেখাতে পারেনি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে এক রকম ছাড় দিয়েছে। ফলে খেলাপির যোগ্য ঋণও খেলাপি হচ্ছে না। এরপরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক ঋণ দিয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে এসব ব্যাংকের খেলাপি ছিল ৪২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। নানা ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন আইএমএফ। এ কারণে ঋণ খেলাপি হওয়া ঠেকানো, আদায় বাড়ানো ও ঋণ বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনার ওপর জোর দিয়েছে তারা।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, করোনায় ব্যাংকিং খাতের ক্ষতি ও গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চায় আইএমএফ। এছাড়া করোনাকালীন সময়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা হয়। তবে আলোচনায় গুরুত্ব পায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন। স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং ব্যাংকগুলোর সার্বিক পারফরম্যান্স বৃদ্ধিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ আসে বৈঠকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় মেয়াদের প্রণোদনা ঋণ বিতরণ শুরু হলেও কাক্সিক্ষত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পার হয়ে গেলেও দ্বিতীয় মেয়াদে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের হার মাত্র ১ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঋণের চাহিদা কেন বাড়ছে না এ বিষয়টি জানতে চেয়েছে আইএমএফ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন ঋণ হিসাবে প্রথম মেয়াদে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এর বাস্তবায়ন হার ছিল ৮১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। উল্লিখিত খাতে দ্বিতীয় মেয়াদেও ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করা হয়। ১ জুলাই থেকে প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৫১৯ কোটি টাকা, যা ঘোষিত প্যাকেজের ১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য চলতি মূলধন ঋণ হিসাবে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ৪৭৭ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের ঘোষণা করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। এ প্যাকেজের আওতায় এখন পর্যন্ত সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৬৫টি প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত ৩৭৫ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বিতরণ করে তা আদায় হবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। তাই দ্বিতীয় মেয়াদে নতুন ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।