সঠিক তথ্য দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক!
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে সন্তুষ্ট হতে পারছে না আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি মনে করছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবায়নে সমস্যা রয়েছে। প্রকৃত তথ্য গোপন করতে এমনটা করা হচ্ছে বলে ধারণা আইএমএফের। তথ্যের বিষয়ে আগে প্রশ্ন থাকলেও সম্প্রতি তা জোরেসোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এই সংস্থা। আর গত রবিবার খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে।
১০ দিনের সফরে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বা মিশন ঢাকায় এসেছে। দলটি ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবে। আইএমএফের প্রতিনিধিদলে নেতৃত্বে রয়েছেন সংস্থাটির উন্নয়নবিষয়ক সহকারী পরিচালক রাহুল আনন্দ। সফরের অংশ হিসেবে দলের সদস্যরা অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তারা। গত রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেন আইএমএফের প্রতিনিধিরা। আইএমএফের মিশনের সঙ্গে প্রধান বৈঠকটি হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান এবং বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ বিশ্বাস ও সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালকেরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, আইএমএফ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কেননা, আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই হার ৮ শতাংশের বেশি। সরকারি ব্যাংকে এই হার ২০ শতাংশের বেশি। এছাড়া খেলাপি ঋণের সঠিত তথ্য উপস্থাপন হচ্ছে না। একদিকে নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ রয়েছে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাকে তারা আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছেন। তা না হলে ব্যাংকিং খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের সঠিক তথ্য প্রকাশের কথাও তারা বলেছেন। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, খেলাপি ঋণের হিসাব দুইভাবে করা হয়-একটি গ্রস, অপরটি নিট। গ্রস হিসাবে খেলাপি ঋণ বেশি হলেও নিট হিসাবে কম। এই হার ৩-৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। করোনার কারণে খেলাপি ঋণ কিছুটা বেড়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলে প্রতিনিধিদলটি। এর জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত রীতি মেনে দীর্ঘদিন ধরে একই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রিজার্ভ বেশি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। আইএমএফের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৬ বিলিয়ন ডলারের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হবে ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে নতুন শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ, আবাসন, পুঁজিবাজার, ব্যাংকে সঞ্চয় ও নগদ টাকা জমার প্রায় সব খাতে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে সরকার। এই সুযোগ নিয়ে এ পর্যন্ত কত টাকা সাদা হয়েছে এবং এর বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি কেমন, প্রথম বৈঠকেই তা জানতে চেয়েছে প্রতিনিধিদল। বৈঠকে আইএমএফের কর্মকর্তারা জানতে চান, যদি কালোটাকা বেশি সাদা না-ই হয়, তাহলে এই সুযোগ বারবার কেন দেওয়া হয়?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ঐ বৈঠকে করোনায় ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি, টিকা আমদানির খরচ, ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত তারল্য ও এক অঙ্কের সুদহার, অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে পদক্ষেপ এবং এফএটিএফের সুপারিশ বাস্তবায়ন, মুুদ্রানীতির আধুনিকায়ন, চলমান মুদ্রানীতিসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়।
আর্থিক খাতের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে প্রতি বছরই বাংলাদেশ সফরে আসে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে মাঝের দুই বছর তাদের কোনো সফর ও বৈঠক হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এবার আইএমএফ মিশন সফরে এসেছে। এর আগে আইএমএফ সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করে ২০১৯ সালে।