বারবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক কতদূর?
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। প্রতিনিয়তই সড়কে ঝরছে প্রাণ। আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। থামছে না দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে নিয়ে আন্দোলন হলেও আবার স্তিমিত হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনা রোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হলেও বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই। এমনকি সড়কে বেপরোয়া যান চলাচলও বন্ধ হয়নি।
সড়ক পথের নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা রোধ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে যে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাস হয়েছিল আজো তা বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক নির্দেশনাগুলোরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার আসলে পরিবহন মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ভয় পায়। আইনটি যখন কার্যকর করার চেষ্টা করা হলো, তখন অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের নামে সারা দেশে পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হলো। তাই ভয় পায় বলেই সরকার আইনটিকে একটা ধোঁয়াশার জায়গায় রেখেছে। জনগণ জানে না, দেশে কি আদৌ এই আইনটা আছে নাকি পুরনো আইনে চলছে।
অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় চলমান এমন নৈরাজ্যের মধ্যে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বেপরোয়া বাসের চাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ জন শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে।
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীরা সড়কে-যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে, দেশে প্রথমবারের মতো ইমার্জেন্সি লেন তৈরি করে প্রশংসিত হয়। তারা যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা শুরু করলে দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যানবাহন আটকে যায়। শিক্ষার্থীদের সেই অহিংস স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেশের সড়ক পরিবহন খাতের দায়হীন, মায়াহীন সংকটাপন্ন চেহারা ফুটে উঠেছিল।
ব্যাপক জনসমর্থিত সেই আন্দোলন চলাকালে সরকার শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানায়। শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যায়, কিন্তু সড়কে আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের এমন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ দ্রুততার সাথে সংসদে পাস করে।
দেশবাসী প্রত্যাশা করেছিল নতুন আইনের মাধ্যমে দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু হয়নি। কারণ অদ্যাবধি আইনটির বাস্তবায়নই শুরু হয়নি। সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাস করার কয়েক মাস পরই ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল’ শাজাহান খানকে প্রধান করে ‘সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটি’ নামে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে।
এই কমিটি ১১১টি সুপারিশ তৈরি করে ওই বছরের ২২ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর কাছে জমা দেয়। সেই সুপারিশসমূহে নতুন কিছু ছিল না, পুরনো কথাই নতুন করে লেখা হয়েছিল। সেখানে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের প্রতি কোনো নির্দেশনা ছিল না, চাঁদাবাজি বন্ধেও ছিল না কোনো পরামর্শ। শুধু জনসচেতনতা ও অবকাঠামোগত বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকার আবার টাস্কফোর্স গঠন করে।
অর্থাৎ শুধু কমিটি আর কমিটি। অবশ্য সেই সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। সংসদে পাসকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ আইন বাস্তবায়ন না করে কেন আবার নতুন কমিটি গঠন এবং সুপারিশ তৈরি করা হলো? সেটি নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠে। এছাড়া সড়কে নিরাপত্তায় ২০১৮ সালের জুনে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
নির্দেশনাগুলো হলো-দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা।
এসব নির্দেশ যাতে বাস্তবায়িত হয়, তা দেখতে তিনজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। রহস্য জনকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক নির্দেশনাগুলোরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বাসচালকরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো সড়কে যানবাহন চালাচ্ছে। আর একের একর পর দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরছে প্রাণ।
গত ২৪ নভেম্বর রাস্তা হেঁটে পার হওয়ার সময় গুলিস্তানে একটি গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যু হয়।
এর রেশ কাটতে না কাটতেই মাত্র একদিনের ব্যবধানে রাজধানীতে ডিএনসিসির ময়লার গাড়ির চাপায় আবারও প্রাণ হারান এক মোটরসাইকেল যাত্রী। বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের উল্টোদিকে গাড়ির চাপায় প্রাণ হারালেন আহসান কবির খান।
নাঈম হাসানের মৃত্যুর ঘটনার জের ধরে ২৪ নভেম্বর থেকে রাজধানীতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তা অবরোধ ও বিক্ষোভ করছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের এ দাবি বাস্তবায়নের পক্ষে কোনো সমর্থন আসেনি। ফলে গতকাল শনিবারও দাবি আদায়ে তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছে।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, দেশের পরিবহন খাত দীর্ঘদিন ধরে ১৯৩৯ সালের ‘বেঙ্গল মোটর ভেহিকেল অ্যাক্ট’ এবং ১৯৮৩ সালে মোটরযান অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।
২০১০ সালে সড়ক আইনের কার্যক্রম শুরু হলেও চূড়ান্ত হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। এরপর সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও এ যাবৎ সেটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো আইন পাশের পর সেটার প্রয়োগ এভাবে বার বার পিছিয়ে দেওয়া একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এখন প্রশ্ন থেকে যায় আদৌ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ আছে কি-না। আর সংসদে পাশ হওয়া একটি আইন রহিত করতে হলেও সংসদে করতে হয়। কোনো মন্ত্রী তো মুখের কথায় তা করতে পারেন না। এখানে আসলে জনগণের সঙ্গে একটা তামাশা করা হচ্ছে। নিরাপদ সড়কের চাপ কমিয়ে দিতেই মালিক-শ্রমিকদের চাপে এটা করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশের যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কে অহরহ দুর্ঘটনা, গণপরিবহনে যাত্রী হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ইত্যাদি নিত্যদিনের দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে বড় ধরনের কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে কিংবা কোনো দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনবিক্ষোভ তৈরি হলে সরকার সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে তৎপরতা দেখায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নানারকম প্রতিশ্রুতি দেন, কমিটি গঠন করেন, বৈঠক করেন, সুপারিশমালা তৈরি করেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। দীর্ঘকাল ধরে আদর্শহীন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা, বেড়ে উঠা চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটই গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে প্রধানমন্ত্রী ৬ দফা সুপারিশ করেছিলেন, সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ এই বেপরোয়া চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কারণে আলোর মুখ দেখেনি। একটা আইন পাশ করে তা আবার রহিত করে রাখা হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক আইনটি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বাস্তবায়ন করা হলেও, কোনো এক অদৃশ্য কারণে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে কিছু বিষয়ের উদাসীনতা। নানা অব্যবস্থাপনা দূর করার বিষয়ে বরাবরই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। যারা সরকারি দলে আছেন শুধু তারাই নন, যারা বিরোধী দলে ছিলেন তারাও এই সমস্যা নিরসনে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেননি। তাদেরও ইচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। চাপের মুখে আইনটি কার্যকর করা না গেলে সেটা সবার জন্যই পরাজয় হবে।