ভারতের কৃষক আন্দোলনে চূর্ণ বিচূর্ণ মোদির ‘স্ট্রংম্যান’ ভাবমূর্তি

0

বছরব্যাপী এক লাখেরও বেশি কৃষকের প্রতিবাদের মুখে অবশেষে, চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন।

দরিদ্রতা ও কর্পোরেটাইজেশনের বিরুদ্ধে কৃষকদের এই সংগ্রামে প্রাণ দিতে হয়েছে অন্তত সাত শতাধিক মানুষকে। ব্যাপক রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মধ্যে ছিল গ্রেপ্তার, সহিংসতা শারীরিক নির্যাতন ও ইন্টারনেট বিভ্রাট। সরকারের সঙ্গে এগারো দফা ব্যর্থ আলোচনার পর, শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে পিছু হাঁটতে বাধ্য হন মোদি।

মোদির বিরুদ্ধে ঐক্য

মোদি ও তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় ফিরে আসার সাত বছরে, গণতান্ত্রিক ভিন্নমতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে মূলত হিন্দুত্ববাদের (হিন্দু জাতীয়তাবাদী) ওপর ভর করে, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন ও সহিংসতাই দেখিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ নং ধারা বাতিলের পাশাপাশি ২০১৯ সালের মুসলিম বিরোধী নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ, মোদি সরকারের এমন স্বেচ্ছাচারিতারই সাক্ষ্য বহন করে।

তবে, দীর্ঘদিনব্যাপী কৃষকদের এই বিক্ষোভ মোদি সরকারের গতানুগতিক সেই প্রথা ভেঙে দিয়েছে। সামাজিক শ্রেণী, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে লাখো মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল কৃষক আন্দোলনে। জমিদার জাট থেকে শুরু করে ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকরাও বড় কর্পোরশন ও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছিলেন।

জাট নেতা রাকেশ টিকাইত যিনি ২০১৪ সালে মোদির নির্বাচনী প্রচারণার বড় সমর্থক ছিলেন, তিনিও প্রগতিশীল-বাম গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কৃষি আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। আন্দোলনটি ভারতের দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে আম্বেদকরীয় নেতাদের কাছ থেকেও সমর্থন পেয়েছে। এমনকি জাতিগত সহিংসতা ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির জন্য কুখ্যাত উত্তর ভারতের খাপ পঞ্চায়েতও (পরিষদ) কৃষক বিক্ষোভে অংশ নিতে নারী ও তথাকথিত নিচু জাতের লোকেদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিল।

কৃষক বিক্ষোভ উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে। কৃষি সংকট ও নব্য উদারনৈতিক পুঁজিবাদের আগ্রাসে সৃষ্ট দুর্বলতা ও অনিশ্চয়তার অনুভূতিই মূলত, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এই অনুভূতিই ধর্মী ও জাত বিভাজনকে ছাপিয়ে একসঙ্গে আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই

হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর দাবি, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী খলিস্তানিরা কৃষক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করেছে। তবে বিক্ষোভকারীদের ভাষ্যে, তারা নিজেরদের বস্তুগত স্বার্থ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তারা বিজেপির ধর্ম, বর্ণ ও জাতভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিক্ষোভ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে ধর্ম ও জাতকে দূরে রেখে শ্রেণী সংহতির ভিত্তিতে কৃষকদের পরিচয়ের ওপরেই আলোকপাত করা হয়েছে। কোনো প্রতিবেদনেই প্রতিবাদী কৃষকদের শিখ কিংবা জাট হিসাবে সংজ্ঞায়িত করার অপচেষ্টা সফল হয়নি।

কৃষক সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের লড়াই, এমনকি ক্ষমসীন দলের মধ্যে মতবিরোধের জন্ম দিয়েছে। মেঘালয়ের বিজেপি রাজ্যের গভর্নর সত্য পাল মালিক, কৃষকদের উদ্বেগের কথা না শোনার জন্য কেন্দ্র সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনি কৃষকদের পক্ষে কথা বলতেই থাকবেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাতে ‘পরিণাম যাই হোক না কেন’।

ভারতের কৃষকদের এই আন্দোলন আন্তর্জাতিক সমর্থনও পেয়েছে। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠীত সকল সংহতি ও অনুদান সভার আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ভারতীয় শিখ প্রবাসীরা। ব্রিটিশ ও কানাডার পার্লামেন্টের এমপিরা বিক্ষোভের সমর্থনে বক্তব্য রেখেছিলেন। এই ঘটনাগুলো মোদির বৈশ্বিক ভাবমূর্তিতে চরম আঘাত হেনেছে।

আন্দোলন সমর্থকরা মহামারির মাঝেও অনেক কষ্টে নিজেদের মাঝে একাত্বতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে, কৃষক সম্প্রদায়ের অধ্যবসায়ের সামনে পিছু হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না মোদির। যদিও নির্বাচনী চাপও মোদিকে নমনীয় নীতি নিতে প্ররোচিত করেছিল, তারপরেও এটিকে সামাজিক একাত্বতার বিজয় হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়।

‘সংসদের সিদ্ধান্ত আন্দোলনে পদদলিত’ 

‘স্ট্রংম্যান’ মোদির আত্মসমর্পণ ও ক্ষমা চাওয়া তার নেতৃত্বের প্রতি জনগণের বিশ্বাসে গুরুতর এক আঘাত হেনেছে। এটি বিজেপির নির্বাচনী সম্ভাবনার উপরেও গভীর প্রভাব ফেলবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস ম্যানরের মতে, বিজেপির জনপ্রিয়তা সু-প্রাতিষ্ঠানিক পার্টি কাঠামোর ওপর নয়, বরং ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক।

মোদির নেতৃত্বের ধরন কেবল বাকপটুতা, ভয় দেখানো কিংবা জবরদস্তির মাধ্যমে নীতি নির্ধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বিজেপির নিজস্ব কাঠামোকেও তিনি নিজের অধীন করে রেখেছেন। তবে কৃষকদের প্রতিবাদ এখন তার সেই উচ্চ ভাবমূর্তিকে ছিন্নভিন্ন করে রেখে দিয়েছে। আর এটি বিরোধী দলের নেতাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মতো আরও কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্ব ভারতের বিকল্প নেতা হয়ে উঠলে বিজেপির মধ্যেও ফাটল দেখা দিতে পারে।

হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে যে ‘নতুন ভারত’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিলেন মোদি, সেই স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করেছে কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে। মোদির পরাজয় সামাজিক আন্দোলনকে আরও উৎসাহিত করেছে। ভিন্নমতের গণতান্ত্রিক অভিব্যক্তিতে যখন অনেকেই আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন, ঠিক তখনই কৃষকদের কাছে পরাজিত হলেন মোদি।

‘সংসদ যা করে, রাস্তা (আন্দোলন) তা ফিরিয়ে দিতে পারে!’ এই স্লোগানকে কৃষকরা সত্যিকার অর্থেই বহাল রাখতে পেরেছেন।

আন্দোলনটি হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক আদর্শে দ্বন্দ্ব তৈরির পাশাপাশি নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গেও একত্বতা প্রকাশ করেছে। যদিও গ্রামীণ জনগণ নানা শ্রেণীতে বিভক্ত, তবে এই বিভাজন গ্রামীণ ভারতীয়দেরকে কৃষি সংকট এবং কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গণসংযোগ গড়ে তুলতে বাধা দেয়নি।

কৃষক সম্প্রদায়ের এই অনিশ্চিত সামাজিক অবস্থা নিঃসন্দেহে একটি বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা; আর সেই অবস্থা থেকে উদ্ভূত অনুভূতিগুলোকে সব সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিতে ব্যাখ্যা করা যাবে না এটিই স্বাভাবিক।

মোদির সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ২০২০ সালের কৃষি আইন তিনটি শীঘ্রই সংসদ বাতিল করবে। তবে, তার কথায় আস্থা নেই কৃষকদের। তাই আইনগুলো চূড়ান্তভাবে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন তারা। আইন তিনটি ছিল পুঁজিবাদী কর্পোরেশনগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে, কৃষকদের তাদের কাছে জিম্মি করে ফেলার একটি পদক্ষেপ। অবশেষে, সেই কর্মসূচি বন্ধ হয়েছে। তবে, আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি বাতিল হওয়া এখনও বাকি।

কৃষকরা দাবি করেছেন, সরকার যেনো কৃষি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থা বজায় রাখে। এ ব্যাপারে আইনী আশ্বাসেরও দাবি করেছেন তারা। এছাড়া ন্যূনতম মজুরি ও শ্রমিক বিরোধী শ্রম কোড বাতিলের পাশাপাশি কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্যও তারা চাপ দিচ্ছেন। এসব দাবি এখনো পূরণ হয়নি। কিন্তু ইতোমধ্যেই মোদির পশ্চাদপসরণ এবং বিক্ষোভ চলাকালীন কৃষক-শ্রমিক ঐক্য ভবিষ্যতে গভীর আশাব্যঞ্জক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com