পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে গাড়িচালক বনে যাওয়াদের দিয়ে চলছে ময়লার গাড়ি, দীর্ঘ হচ্ছে শোকের মিছিল
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের (১৮) মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ করে গতকাল বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। যে গাড়িটি নাঈমকে চাপা দিয়েছিল, সেটির চালক ডিএসসিসির নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন না। তিনি মূলত সংস্থাটির একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেওয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারই ছিল তার কাজ। কিন্তু এমন একজন কীভাবে, কোন যোগ্যতায়, কার অনুগ্রহে ময়লাবাহী গাড়ির চালক হলেন, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন সবাই। যদিও এ বিষয়ে সদুত্তর মেলেনি ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে গাড়িচালক বনে যাওয়া ওই ব্যক্তির নাম মো. হারুন মিয়া। ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক। তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এ ঘটনায় চালকের সহকারী মো. আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রাসেল গ্রেফতার হয়েছেন। তিনিও পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে ডিএসসিসিতে কর্মরত। তাকে তিনদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।
অন্যদিকে হারুন ও আব্দুর রাজ্জাককে কর্মচ্যুত করেছে ডিএসসিসি। পাশাপাশি বরাদ্দকৃত গাড়ি নিজে না চালিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে অন্যকে চালাতে দেওয়ায় করপোরেশনের গাড়িচালক (ভারী) মো. ইরান মিয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে, একই সঙ্গে তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।
এদিকে শিক্ষার্থী নাঈমের মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় আহসান কবীর খান (৪৫) নামের আরও এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ডিএনসিসির একাধিক সূত্র জানায়, পান্থপথে প্রথম আলোর সাবেক কর্মী আহসান কবীর খানকে চাপা দেওয়া ডিএনসিসির ময়লার গাড়িও চালাচ্ছিলেন ফটিক নামে পরিচিত এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তিনি ডিএনসিসির বৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীও নন। ওই গাড়ির মূল চালক মো. হানিফ।
দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, হারুন-ফটিকের মতো এমন আরও বহু গাড়িচালক রয়েছেন, যারা পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও পিয়ন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত (মাস্টাররোল), অথবা বৈধ নিয়োগপ্রাপ্তও নন। কিন্তু পরিবহন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এবং অর্থের বিনিময়ে তারা পেয়েছেন গাড়িচালকের দায়িত্ব।
বুধবার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তা পার হওয়ার সময় ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান মারা যান। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
ডিএসসিসির পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায়, যে ময়লার গাড়ির চাপায় নাঈম হাসান নিহত হয়েছেন, সেটি ভারী যান। সংস্থাটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে ব্যবহারের জন্য এমন ৩১৭টি ভারী যান আছে। কিন্তু চালক আছেন মাত্র ৮৬ জন। বাকি গাড়িগুলো পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাই চালান। যাদের অধিকাংশেরই লাইসেন্স নেই। ফলে সংস্থার গাড়িগুলো মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ঘটনাটির জন্য আমরা খুবই মর্মাহত। তিন বছর ধরে সে (হারুন) ওই গাড়িটি চালায়। এখন বিষয়টি তদন্ত করে বিস্তারিত বলতে পারবো।
তবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে ময়লাবাহী গাড়ি চালানোর বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর আগেও ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির চাপায় একাধিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন পথচারী। এ বছরের মার্চে ডিএসসিসির একই ধরনের গাড়িচাপায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন অপারেটর মোহাম্মদ খালিদ প্রাণ হারান। পরের মাসে যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচা এলাকায় মো. মোস্তফা (৪০) নামে একজন রিকশাচালক নিহত হন। আহত হন ওই রিকশার যাত্রী। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ জনতা ময়লার গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া ২০১৮ সালে জুরাইনে আরেক পথচারী নিহত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির নিয়োগপ্রাপ্ত দুজন চালক বলেন, আগের তিনটি দুর্ঘটনায় জড়িত চালকেরাও পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন। তারা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতেন। বারবার দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রতিকারে ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। কারও বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়নি। বরং এ অদক্ষ চালকদের অর্থের বিনিময়ে কোটি টাকা দামের গাড়িচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, চালক সংকটের কারণেই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ করা কর্মীদের দিয়ে সরকারি গাড়ি চালানো হচ্ছে।