সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রায় ৪০ ভাগই শিক্ষার্থী!
বাংলাদেশে প্রতিবছরই সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যায়, হাজার হাজার মানুষ আহতও হন। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষার্থী ও শিশু। এ তথ্য জানিয়েছে এদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ছয় হাজার ৬৮৬ জন, যার মধ্যে ৭০৬ জন শিক্ষার্থী ও ৫৪১টি শিশু – যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১৯ ভাগ।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত সপ্তাহে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে উঠে আসে যে, গত ১০ মাসে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১,৭৫৮ জন, যার মধ্যে ৬৪৯ জনই শিক্ষার্থী। অর্থাৎ গত ১০ মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৩৭ ভাগই শিক্ষার্থী।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ৬,৬৮৬ জনের মধ্যে ২,০৩৯ জন ছিলেন গাড়ির চালক। অর্থাৎ মোট যতজন মারা গেছে তার প্রায় এক তৃতীয়াংশই ছিল গাড়ির চালক।
এছাড়া ৭৫৭ জন পরিবহন শ্রমিকও ছিলেন নিহতদের মধ্যে। আর এই তালিকায় শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষক ছিলেন ১০৪ জন, এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছিলেন ২০০ জন।
যেসব কারণে শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের’ নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার হার বেশি হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সড়কে নিরাপত্তা নাই, কখনো ছিল না। সমস্যাটা গভীর ও বহুমুখী, এর সমাধানেও বহুমুখীভাবে সমন্বিত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হবে।’
সাইদুর রহমানের মতে, বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্ঘটনায় পড়ার হার বেশি হওয়ার পেছনে পরিবহন ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা যেমন দায়ী, শিক্ষার্থীদের অসচেতনতাও তেমনি দায়ী।
‘মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মারা যাওয়াদের প্রায় ৪০ ভাগই শিক্ষার্থী। সেসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি অনেক সময়ই মোটরসাইকেলে তিন জন ওঠা, হেলমেট ব্যবহার না করা, অতিরিক্ত গতিতে চালানোর প্রবণতা, ট্রাফিক আইন না মানার কারণে দুর্ঘটনা হয়ে থাকে।’
মোটরসাইকেল চড়া ও চালানো বাদেও রাস্তায় চলাচল, গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ বলে জানায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
তবে শিক্ষার্থী ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ট্রাফিক আইন নিয়ে অসচেতনতা বা আইন না মানার প্রবণতা থাকার পেছনে শিক্ষার্থীদের চেয়ে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবহন ব্যবস্থাপনার দায় বেশি বলে মনে করেন তিনি।
‘আমাদের পাঠ্যসূচিতে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো আসলে কার্যকর কিছু না। আর পাঠ্যবইয়ে এ ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানো যাবে বলে আমি মনে করি না।’
তার মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত হাতে-কলমে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ইত্যাদি আয়োজন করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।
‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ভিত্তিতে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাম্পেইন করা দরকার। ক্যাম্পেইন, পোস্টার-ব্যানার প্রদর্শনী আয়োজন করতে হবে। নিয়মিত এ ধরনের কার্যক্রম চলমান থাকলে শিক্ষার্থীরা এই বিষয়গুলোর নিয়মিত অনুশীলন করবে। তাদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতাও ধীরে ধীরে তৈরি হবে।’
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ট্রাফিক আইন নিয়ে সচেতনতার অভাব ও আইন না মানার অভ্যাসও শিক্ষার্থীদের অসচেতনতার একটি অন্যতম কারণ বলে মন্তব্য করেন সেফটি ফাউন্ডেশনের এ কর্মকর্তা।
তার মতে, একজন শিশু যখন দেখবে যে তার অভিভাবক ট্রাফিক আইন মানার ব্যাপারে উদাসীন, তখন সে নিজেও সেসব আইন মানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে না।
আইন না মানার এই প্রবণতাই এক সময়ে অভ্যাসে পরিণত হয় বলে মনে করেন তিনি।
সাইদুর রহমান বলেন, পরিবারের সদস্যদের সচেতন করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের জন্যও প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী, সেমিনারের মত অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতে পারে।
আর ট্রাফিক আইন বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ ও কঠোর বাস্তবায়ন।
সাইদুর রহমান আরো বলেন, ‘২০১৮ সালের সড়ক নিরাপত্তা আইনে যেসব বিধি আছে তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। কোনোভাবেই এর ব্যত্যয় হওয়া যাবে না।’
‘আমাদের দেশে অনেক সময় দেখা যায়, ক্ষমতাশালী বা বিত্তশালী ব্যক্তিরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। এ ধরনের উদাহরণ অন্যদের আইন মানতে নিরুৎসাহিত করে।’
ট্রাফিক আইন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক আইন মানার জন্য অনুপ্রাণিত করা সহজ হবে বলেও মনে করেন তিনি।