শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদন্ড, তাহলে শিক্ষকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে
গত ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ৫টি সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বুয়েটের শিক্ষক, বুয়েটের ইন্ডাসট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান নিখিল রঞ্জন ধর বরখাস্ত হয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে নিখিল রঞ্জনের সম্পৃক্ততা প্রমানিত হয়েছে এবং তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অন্তত ১০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য জানা গেছে। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোটে ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ছাড়াও অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার(বরখাস্ত) মানিক কুমার প্রামানিকসহ বুয়েট ও আহসান উল্লাহ্ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো ৫জন শিক্ষক-কর্মচারির সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দারা। শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদন্ড, তাহলে শিক্ষক সমাজ হলেন জাতি গঠনের কারিগর। শিক্ষকদের দক্ষতা, মান-মর্যাদা ও নীতি-নৈতিকতার অধ:পতন পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রদেহের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। আমাদের আজকের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সমাজে ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও অস্বচ্ছতার যে কালোছায়া দেখা যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে ঢুকে পড়া দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা। শিক্ষাব্যবস্থায় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ও কারিক্যুলাম থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়া ও শিক্ষা প্রশাসনের সামগ্রিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরণের অবক্ষয় ও অবনমন দেখা দিয়েছে।
এক শ্রেণীর তথাকথিত নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষাকে গ্রেডসর্বস্ব ব্যয়বহুল ও অনৈতিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ করে তুলেছে। মূলত বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ভর্তির ক্ষেত্রে মোটা অংকের ডোনেশন, ভর্তি কোচিং ও অনৈতিক লেনদেনের মধ্য দিয়ে শিক্ষাকে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার বস্তুতে পরিনত করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বছরে হাজার হাজার টাকা খরচ করে উচ্চ গ্রেডে পাস করার পর বছরের পর বছর ধরে জুতার তলা ক্ষয় করেও চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা পাওয়া যায় না। এভাবে দেশে একটি উচ্চশিক্ষিত বেকারশ্রেণীর আকার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৫টি সরকারি ব্যাংকে প্রায় দেড় হাজার পদের জন্য নিয়োগ পরীক্ষায় এক লাখ ১৬ হাজারের বেশি প্রার্থী অংশগ্রহণ করে। তবে পরীক্ষা চলার সময়ই প্রশ্নফাঁসের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। মোটা অংকের টাকা দিয়ে কেউ কেউ আগেই প্রশ্ন কিনে নিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছিল। অবশেষে সেই গুঞ্জন বা গুজবের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরা পড়েছেন, ব্যাংক কর্মকর্তা মানিক কুমার প্রামানিককে আত্মসমর্পনের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত চক্রের সদস্যরা গোয়েন্দা জালে ধরা পড়ার ঘটনা এ ক্ষেত্রে অনেক বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। প্রকাশিত রিপোর্টে প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিবকে ওএসডি করা হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিবকেও ওএসডি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিয়োজিত হয়ে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া এসব ব্যক্তির নিয়োগ ও পদায়ণ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মেধা ও যোগ্যতাকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ণের কারণে শিক্ষাঙ্গণে অনৈতিক তৎপরতা লাগামহীন হয়ে পড়েছে।
দেড় হাজার পদের বিপরীতে লক্ষাধিক প্রার্থীর নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকেই বুঝা যায় দেশে চাকরির বাজার কতটা তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে মেধাবিরাই সুযোগ লাভ করা কথা। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস ও গোপন নিয়োগ বাণিজ্যের কারনে সে সুযোগও রুদ্ধ। শিক্ষাজীবনের শুরুতে ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু হওয়া অনৈতিক লেনদেন শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অত:পর চাকরির প্রতিযোগিতায় নেমে শিক্ষাজীবনের মেধা, উচ্চ গ্রেড তেমন কোনো কাজে আসেনা। অনৈতিক লেনদেনই শেষ পর্যন্ত মূল ভ’মিকা পালন করছে। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং একশ্রেণীর দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ড ও অর্থলিপ্সার কুপ্রভাবে আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাই কলুষিত হয়ে পড়েছে। ভর্তি বাণিজ্য থেকে চাকরির নিয়োগে অবৈধ লেনদেন অত:পর চাকরি জীবনে ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনকে অনিবার্য করে তোলার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলা হয়েছে। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগানো থেকে শুরু করে চাকরি পেতে খরচ করা লাখ লাখ টাকার বিনিয়োগ ঘুষের মাধ্যমে উঠিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করার পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি প্রতিটি সেক্টরের নিয়োগ পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মেধাবিদের সুযোগ অবারিত করতে হবে। ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর পেছনের রাঘব বোয়ালদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতির দুষ্টচক্র ভাঙ্গতে হলে সব সেক্টরের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক পক্ষপাত, স্বজনপ্রীতি, অস্বচ্ছতা ও অবৈধ লেনদেন বন্ধের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।