শীত আসতেই ফের মারাত্মক বায়ুদূষণের কবলে রাজধানী
শীত আসতেই ফের মারাত্মক বায়ুদূষণের কবলে রাজধানী। ধুলার কারণে সারাক্ষণই ধূসর হয়ে থাকছে ঢাকার আকাশ। সূর্যের আলোটাও আটকে দিচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ধুলা ও ধোঁয়া। দূষিত বায়ুর কারণে বেড়ে গেছে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ।
দূষণে বিষাক্ত ঢাকার অস্বাস্থ্যকর বাতাস থেকে রক্ষা পেতে গত কয়েক দিন ধরেই ঢাকাবাসীকে চারটি পরামর্শ দিয়ে আসছে বিশ্ব বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়াল। পরামর্শগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখা, ঘরের বাইরে শরীরচর্চা না করা, মাস্ক ছাড়া বাইরে বের না হওয়া ও ঘরের বাতাস দূষণমুক্ত করতে বায়ু বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র চালিয়ে রাখা।
এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় বিশ্বের শীর্ষ ১০ দূষিত নগরীর তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল অষ্টম। শীর্ষে ছিল পাকিস্তানের লাহোর। বায়ুমান সূচকে (একিউআই ) ঢাকার গড় স্কোর ছিল ১৬৫, যাকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঢাকার বাতাসে দূষণের মূল উপাদান পিএম ২.৫ (অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা) ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৮৩ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া নিরাপদ সীমার চেয়ে ১৬.৬ গুণ বেশি। আর এই সূক্ষ্ম কণা ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে মারাত্মক ক্ষতি করে। কোনো এলাকায় বায়ুমান সূচকে (একিউআই) স্কোর ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ৩০১ থেকে ৫০০ হলে তা বিপজ্জনক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীজুড়ে চলছে প্রকল্প। চলছে ব্যক্তিগত ও বেসরকারি নির্মাণকাজ। কোথাও ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে কাজ চলছে না। এ ছাড়া সর্বত্র গ্যাস ফিলিং স্টেশন না থাকায় দূরপাল্লার বাস-ট্রাকে তরল জ্বালানি ব্যবহৃত হয়। প্রতি রাতে এসব বাস-ট্রাক রাজধানীতে ঢুকছে। নির্মাণ সামগ্রী, কৃষিপণ্য নিয়ে রাতে ঢাকায় ঢুকছে হাজার হাজার ট্রাক।
সম্প্রতি ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি জানিয়েছে, ঢাকা মহানগর এলাকায় ১২০টি পরিবহন কোম্পানির ছয় হাজার যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে মাত্র ১৩টি কোম্পানির ১৯৬টি বাস-মিনিবাস সিএনজিতে চলে। অর্থাৎ অনেক বাস সিএনজি থেকে তরল জ্বালানিতে ফিরছে। এসব কারণে দূষণ বাড়ছে।
সরেজমিন গতকাল দুপুরে রাজধানীর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়, ধুলার কারণে ২০ ফুট দূরের গাড়ির নম্বর প্লেট স্পষ্ট বোঝা যায় না। আশপাশের সব গাছের পাতার সবুজ ঢেকে গেছে ধুলার পুরু আস্তরে। এসব নির্মাণ এলাকা দিয়ে একটি যানবাহন গেলেই পেছনের পুরো এলাকা ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পানি ছিটানোর পাশাপাশি নির্মাণ সামগ্রী ছালার চট বা ত্রিপল দিয়ে ঘিরে ধুলা নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা থাকলেও গতকাল সরেজমিন তেমন চিত্র কোথাও দেখা যায়নি। আবার দূষণ কমাতে সড়কে নির্মাণ সামগ্রী না রাখতে দুই সিটি করপোরেশন নির্দেশ দিলেও এখনো রাজধানীর অলিগলিগুলো ইট-বালু-পাথরের দখলে। বালুর ওপর দিয়ে দ্রুতগামী যানবাহন ছুটে যাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে।
রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, দরজা-জানালা বন্ধ রাখার পরও ঘরের আসবাব-ফ্লোর দিনের মধ্যে কয়েকবার মুছতে হয়। মোছার এক-দুই ঘণ্টার মধ্যেই ফের ধুলার আস্তর পড়ছে। রাজধানী থেকে টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনের গাড়ি তুলে দেওয়ার পাশাপাশি যানবাহনে সিএনজি ব্যবহার শুরু হওয়ায় কমতে শুরু করেছিল দূষণ। তবে বর্তমানে অনেক গাড়ি ফের তরল জ্বালানিতে ফিরতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে সড়কে বাড়ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। এগুলো বাতাসে কালো বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ছে।
২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য অর্ধেক দায় তরল জ্বালানি পোড়ানো ধোঁয়ার, যা মূলত যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা ৫ লাখের মতো। এর বড় একটি অংশই ঢাকায় চলাচল করছে। নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এসব গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠানো হলেও প্রতি বছর মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা ২০-৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে।