খেলাপি ঋণের অর্ধেকই শীর্ষ ৫ ব্যাংকে
ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৪৫ শতাংশই আছে মাত্র পাঁচটি ব্যাংকে। বাকি ৫৫ শতাংশ ৫৪টি ব্যাংকে। গত ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ।
এর মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা পাঁচ ব্যাংকেই আছে ৪৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক। ১০ ব্যাংকে (শীর্ষ পাঁচসহ) রয়েছে ৬২ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৬২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বাকি ৪৯ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৩৬ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৩৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানদণ্ডে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে ২৫টি ব্যাংকই ঝুঁকিতে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ৪৩ ব্যাংক ঝুঁকিতে।
বৃহস্পতিবার রাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রকাশিত ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন এপ্রিল-জুন ২০২১’ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতি তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে আর্থিক খাতের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে তুলে ধরা হয় ঝুঁকির মাত্রা ও এগুলো মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশ।
প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যেমন কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, তেমনি সম্পদও কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। কিছু ব্যাংকে, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে লাগামহীনভাবে। অন্য দিকে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে সম্পদ বেড়েছে।
ফলে ব্যাংকিং খাতে সম্পদের যেমন সুষম বণ্টন হচ্ছে না, তেমনি খেলাপি ঋণও কোনো ব্যাংকের বেশি, কোনো ব্যাংকের একেবারেই কম। ব্যাংকগুলোর সুষম ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে এমনটি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদের ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশই শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকে। ১০ ব্যাংকে রয়েছে ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদের প্রায় অর্ধেকই রয়েছে ১০ ব্যাংকে। বাকি অর্ধেক ৪৯টি ব্যাংকে। ব্যাংকিং খাতে মোট সম্পদ হচ্ছে ১৭ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাহকের কাছে বিতরণ করা ঋণ হচ্ছে ১১ লাখ কোটি টাকা। বাকিগুলো অন্যান্য সম্পদ। ঋণের মধ্যে ৮ দশমিক ২ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণ ৮৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।
সন্দেহজনক ঋণ ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং নিুমানের ঋণ ছয় হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ ছাড়ে তা কমে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকায় নেমে আসে।
গত মার্চে তা আবার বেড়ে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। গত জুনে তা আরও বেড়ে প্রায় লাখ কোটি টাকায় ওঠে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণের হার বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই হার ছিল ৮৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭ শতাংশ। ২০২১ সালের জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়ে যাওয়াটা আতঙ্কের। এ ঋণ বৃদ্ধির হার ইঙ্গিত করে ঋণ বিতরণের সময় নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না। আগে যেসব জাল জালিয়াতি হয়েছে সেগুলো এখন আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হচ্ছে।
ব্যাংকারদের অবশ্যই আদায় অযোগ্য ঋণ বাড়ার গতি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্য ধরে রাখা যাবে না। আদায় অযোগ্য ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকের সম্পদ আটকে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে ২ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ আছে মাত্র ২টি ব্যাংকের। ২ শতাংশের বেশি থেকে ৩ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯টি ব্যাংকের।
৩ শতাংশের বেশি থেকে ৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ১৮টি ব্যাংকের। ৫ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণের হার ১০টি ব্যাংকের। ১০ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ ৪টি ব্যাংকের, ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশের কম ৩টি ব্যাংকের। ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮টি ব্যাংকের। খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির হারও বাড়ছে।
গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখার প্রয়োজন ছিল ৭০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। রাখা হয়েছে ৬৫ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ঘাটতি ছিল ৮ শতাংশ।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী, ঝুঁকি কমাতে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ তাদের মোট ঋণের ৫ শতাংশের কম থাকতে হবে। এর বেশি থাকলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে শনাক্ত করা হয়। এদিকে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের বেশি হলেই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে ধরা হয়। ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ হলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের দিক থেকে ২৫টি ব্যাংকই ঝুঁকিতে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ৪৩ ব্যাংক ঝুঁকিতে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ ও লিজের পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ও লিজের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণ বা লিজের ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা।
যা মোট ঋণ ও লিজের ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। গত আড়াই বছরের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ ও লিজের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ।