১০৬৩২ কোটি টাকা আটকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের
অর্থঋণ ও অন্য আদালতে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ১৭ হাজার ৪৩২টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এতে আটকে আছে ১০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। এ টাকার একটি বড় অংশ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকরা নানা জালিয়াতি করে লোপাট করেছেন-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
এছাড়া নামে-বেনামে আর বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় দেওয়া ঋণগুলোও এখন ফেরত আসছে না। এ কারণে অর্থ আদায়ে বাধ্য হয়ে মামলা করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অঙ্ক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে আদালতে মামলার স্তূপ। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত নিষ্পত্তি নেই। ঝুলে আছে বছরের পর বছর। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আদালতে মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখে বহাল তবিয়তে দেশের ব্যবসা ও রাজনীতিতে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন ঋণখেলাপি রাঘববোয়ালরা।
তাদের অনেকেই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালক হয়ে বছরের পর বছর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই সংকট নিরসনে প্রয়োজন মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমানো। এটি করতে না পারলে ভবিষ্যতে সংকট মহামারি আকার ধারণ করবে, যার সুবিধা লুটবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা।
জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম বলেন, বিপুল অঙ্কের এই টাকা আটকে থাকার জন্য মূলত দায়ী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা।
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তারা বাধা দেন। আদালত থেকে বারবার স্টে অর্ডার বা স্থগিতাদেশ নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে দেয় না। ফলে শুধু বছর নয়, যুগের পর যুগ ঝুলে থাকে এসব মামলা। তিনি বলেন, টাকা আদায়ে ১৯৯৯ সালে করা একটি মামলার চূড়ান্ত রায় আজও পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের পাসপোর্ট জব্দ করে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সব সুযোগ-সুবিধা বাতিলের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও বয়কট করতে হবে। তা না হলে টাকা আদায় করা সম্ভব হবে না।
অর্থঋণ আদালত ও অন্যান্য আদালতে দায়ের ও নিষ্পত্তি মামলাসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আদালতে দায়ের করা মামলার সংখ্যা (ক্রম পুঞ্জীভূত) ২৮ হাজার ২০৭টি। এসব মামলার বিপরীতে অর্থের পরিমাণ ১২ হাজার ৮৯০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৫টি মামলা, যেখানে অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২৫৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। জুন শেষে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ১৭ হাজার ৪৩২টি, এসব মামলার বিপরীতে অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।
জানা যায়, সাধারণত যেসব খেলাপি ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকে, সেগুলো আদায়ের জন্যই এনবিএফআইগুলো আদালতে মামলা করে থাকে।
পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, এককালীন পরিশোধসহ গত এক দশকে ঋণখেলাপিদের জন্য একাধিক বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তারপরও ঋণ পরিশোধ করছে না। ক্রমাগতভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। অন্যদিকে দু-একটি ঘটনা ছাড়া ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ তেমন চোখে পড়ে না।
এমন পরিস্থিতিতে মামলাজট কমাতে স্পেশাল কোর্ট চালু করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এনবিএফআই-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা।
বিএলএফসিএ-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, মামলা বাড়ছে; কিন্তু কোর্টের সংখ্যা বাড়েনি। এ কারণে মামলাজট লেগে আছে। ব্যাংক, বিমাসহ পুরো আর্থিক খাতের লাখ লাখ মামলা একই কোর্টে পরিচালিত হচ্ছে।
মামলা নিষ্পত্তির জন্য আইনে একটা সময় বেঁধে দেওয়া আছে। কিন্তু মামলা বেশি হওয়ায় দেখা যায়, মামলার তারিখ অনেক সময় নিয়ে নির্ধারণ করা হচ্ছে। এতে দীর্ঘসূত্রতায় মামলা ঝুঁলে আছে। এছাড়া মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া বেশ লম্বা, বিচারক ইচ্ছা করলেও রায় দিতে পারেন না। এ কারণে বছরের পর বছর মামলা নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। তিনি জানান, করোনার কারণে দীর্ঘদিন কোর্ট বন্ধ ছিল, তাই আরও সমস্যা বেড়েছে।
এখন যদি স্পেশাল কোর্ট না দেওয়া হয়, অনেক বড় সমস্যা হবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য স্পেশাল কোর্টের বিকল্প নেই। বিশেষ আদালতের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে স্পেশাল কোর্টের ব্যবস্থা করা, যারা শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ মামলাগুলো নিষ্পতি করবে। তা না হলে মামলা বাড়তেই থাকবে। সংকটও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন হচ্ছে। সেখানে ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে চিহ্নিত করে সরকার শাস্তি দেবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা বিদেশ যেতে পারবে না। তাদের পাসপোর্ট জব্দ করবে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হবে। এসব আইন যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে আইনি প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ আদায়ে সাধারণত চার ধরনের আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। আদালতগুলো হলো অর্থঋণ আদালত, দেউলিয়া আদালত, সার্টিফিকেট আদালত ও দেওয়ানি আদালত। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতেই বেশির ভাগ মামলা করা হয় এবং এ আদালতেই এনবিএফআই-এর বেশির ভাগ অর্থ আটকে আছে।
দেশে এখন ব্যাংকবহির্ভূত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬৭ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১০ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ।