জীবন-জীবিকায় মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবে মধ্যবিত্তের মরণদশা

0

বাংলাদেশিরা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা জাতি। ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে সে সংগ্রামের গল্প লেখা রয়েছে। মরণঘাতি করোনায় সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষের সংসারের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। পেশাগতভাবে অর্থনীতির মেরুদণ্ড প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। ব্র্যাকের গবেষণা বলছে করোনায় আয় কমেছে দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষের। কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ আর কর্মহীন হয়েছেন ২৮ শতাংশ মানুষ। অদৃশ্য ভাইরাসকরোনা এখন নিয়ন্ত্রণে আসায় মানুষ আশার আলো দেখছে। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। ছোট-বড়-ধনী-গরিব বিভিন্ন পেশাজীবী-চাকরিজীবী সবস্তরের মানুষ যখন নিজ নিজ সংসার আর দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করার ব্রত নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে; তখন তেলের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের সোজা করতে যাওয়া মেরুদণ্ডে আঘাত করার নামান্তর। এই তেলের মূল্যবৃদ্ধি গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ যাপিত জীবনের সবকিছুর মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোটি কোটি মানুষ।

দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি গভীর সঙ্কটে পড়ে গেছেন। বাড়তি আয় নেই; অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বাসভাড়া লাগামহীন, ব্যাংক আমানতে সুদ কম, গণপরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, ঘরে ঘরে বেকারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধিতে জীবন এবং জীবিকায় এই শ্রেণির জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনার দুরবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা যখন এই শ্রেণির মানুষের ব্রত; তখন তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সবকিছুই লন্ডভন্ড। জীবনযুদ্ধে থাকা মানুষগুলোর জীবন বাঁচাতে জীবিকা রক্ষা কঠিন হয়ে গেছে। অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবন যাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা কি করবেন, এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না। যার জন্য নির্ধারিত মূল্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য টিসিবির ট্রাকের সামনে কর্মজীবী মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। যারা টিসিবির পণ্য ক্রয় করতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নিরুপায় হয়েই তারা পণ্য কেনেন কষ্ট করে। এ সব পণ্য বাজারে কেনার সামর্থ তাদের নেই।

করোনার প্রভাবে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ছিল স্থবির। এতে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছিল দেশের এই মধ্যবিত্ত। এই শ্রেণির অনেকেই চাকরিচ্যুত হন কারো কমিয়ে দেয়া হয়েছে বেতন। অন্যান্য উৎস থেকেও কমে যায় আয়। লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরিতে যারা নতুন আসেন, তাদের বেশিরভাগই এই মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। দীর্ঘ দেড় সরকারি নিয়োগ বন্ধ থাকায় তাদের ‘স্বপ্ন’ এতোদিন ধোঁয়াশায় ঢাকা পড়েছিল। এখন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু সব পরীক্ষা রাজধানীতে হওয়ায় পরীক্ষার্থীদের অনেকেই নানা পন্থায় অর্থ সংগ্রহ করে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় এতেও পরিবারগুলোকে বাড়তি চাপে পড়তে হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংসারের খরচ কমিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য মরিয়া মানুষগুলো সবকিছুই মূল্যবৃদ্ধিতে হতোদ্যম। এ অবস্থায় সিপিডি জ্বালানির মূল্য আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করার মেকানিজমে আমরা বৈজ্ঞানিক কোনো মেথড মানা হয়নি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিত্তবানদের ওপর প্রভাব না পড়লেও মধ্যবিত্ত, দরিদ্র এবং যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, যারা করোনা আক্রান্ত অর্থনীতিতে নতুন করে রিকোভারির চেষ্টার মধ্যে রয়েছে, তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের মধ্যবিত্তদের অবস্থা শোচনীয়। এ অবস্থা উত্তরণে খুব বেশি কিছু করার নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে মধ্যবিত্তদের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। দেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে যাদের দৈনিক আয় ১০ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে তারাই মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে মধ্যবিত্তদের মাসিক আয় বাংলাদেশি টাকায় ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বর্তমানে দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। এর মধ্যে ঢাকা শহরে বাস করেন প্রায় ৮০ লাখ। এরা নিজেদের আয় দৈনন্দিন খরচসহ সন্তানদের পড়াশোনা, ভ্রমণ, বিনোদন, চিকিৎসাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচগুলো মিটিয়ে কিছু সঞ্চয়ও করতে পারেন। এদের একটি বড় অংশ ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আরেকটি অংশ চাকরিজীবী। কিন্তু করোনার কারণে গত দেড় বছর এরা নানান সঙ্কট মোকাবিলা করেছেন। ব্যবসা বন্ধ, চাকরি হারানো, চাকরির বেতন কমে যাওয়া ইত্যাদি চাপ মোকাবিলা করে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এই ঘুরে দাঁড়ানোর সময় পণ্যমূল্য মানুষগুলোর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বেকায়দায় ফেলেছে। এখন তেলের দাম বৃদ্ধি করায় পণ্যমূল্য আরো বৃদ্ধির পাশাপাশি যাতায়াতে গণপরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত যারা প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করেন; তারা কার্যত বাস-মালিক ও বাস পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মিদশায় পড়ে গেছেন। বাসা থেকে অফিস এবং অফিস থেকে বাসায় যাতায়াতে তারা গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল।

বাস ভাড়ায় নৈরাজ্য : রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। ডিজেল ও সিএনজি চালিত বাসে ‘স্টিকার লাগানো’ বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত, মালিক সমিতির নানান হুঁশিয়ারি, বাসে ভাড়ার চার্ট লাগানো কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। বাস মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন। বাসের ড্রাইভার, হেলপার, কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গে যাত্রীদের ঝগড়া, মারামারি হচ্ছে নিত্যদিন; কিন্তু যাত্রীদের জিম্মি করে ভাড়া বেশি নেয়ার প্রবণতা কমছে না।

সরকার ডিজেলের মূল্য লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করে মালিকদের চাহিদামতো পরিবহন ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সে নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। বিআরটিএ ঘোষিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। মালিকদের নির্দেশে পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে বেশি ভাড়া আদায় করছে। এতে মধ্যবিত্ত যাত্রীদের অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।

গণপরিবহনে চলাচল করে সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা। বিভিন্ন পেশাজীবী এই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর যে সদস্যের রোজগারে সংসার চলে তাদের প্রতিদিন বাসা ও কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয় গণপরিবহনে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি রুটের বাস ভাড়া বেড়ে গেছে। ফলে মধ্যবৃত্তি পরিবারের কর্তারা বাড়তি চাপে পড়ে গেছেন। নিয়মিত অতিরিক্ত বাস ভাড়া দেয়া তাদের কাছে দায় হয়ে গেছে। গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাসে যাতায়াত করে দেখা গেছে সড়কে চলছে ভাড়া-নৈরাজ্য। নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সাধারণ যাত্রীদের মাঝে। কিন্তু তারা নিরুপায়-জিম্মি।

বাজারে সবকিছুই ঊর্ধ্বমুখী : চাল, আটা, তেল, চিনি ও ডাল আগের মতোই বাড়তি দামে কেনাবেচা হচ্ছে। সবকিছুই ঊর্ধ্বমুখী। তেলের মূল্যবৃদ্ধির গরম বাজারে লাগায়- জীবন-যাত্রার ব্যয় বেড়েছে সাধারণ মানুষের। তাদের আয় ও সঞ্চয়ে প্রভাব পড়েছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তদের সঞ্চয় বলতে এখন আর তেমন কিছুই নেই। দিন এনে দিন খেয়ে কাটছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের আরও চাপে ফেলেছে শীতকালীন সবজির বাড়তি দাম। উচ্চমূল্যে এসব সবজি কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষ অনেকটাই দিশেহারা। গতকাল শুক্রবার চিকন থেকে মোটা বিভিন্ন মানের চাল ৫৬ থেকে ৮২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। প্যাকেটজাত আটার কেজি ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা। সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫৬ টাকা থেকে ১৬৫ টাকা লিটার দরে। চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮২ থেকে ৮৬ টাকা। মসুর ডালের কেজি ৯০ থেকে ১৩০ টাকা। পেঁয়াজ গত সপ্তাহের মতোই ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মাছ-গোশত সবকিছুর দাম বেশি।

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। অনৈতিক মুনাফা করা ব্যবসায়ীকে অবশ্যই আইনের আওতায় আসতে হবে। তবে সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যুক্তিসঙ্গত হয়নি। এমন সিদ্ধান্ত সরকারের নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং রাজনৈতিকভাবে এটা কোনো আলোকিত সিদ্ধান্ত নয়। এমন সিদ্ধান্ত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জীবনযাপনে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। অথচ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান বলেছেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। আমলাদের এতো বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com