সালমান খুরশিদের বই নিয়ে গরম উত্তরপ্রদেশের রাজনীতি
ভারতে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে এমনিতেই বিজেপি নেতারা বিভিন্ন প্রসঙ্গে হিন্দুত্ব ও অযোধ্যার রামমন্দির টেনে আনছেন। বৃহস্পতিবার অযোধ্যার রায় নিয়ে কংগ্রেস নেতা সালমান খুরশিদের লেখা বই বিজেপির হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিল। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলা নিয়ে কংগ্রেসের নেতারাও নানা জনে নানা মত প্রকাশ করলেন।
খুরশিদ তার ‘সানরাইজ ওভার অযোধ্যা’ বইয়ে সনাতন হিন্দুধর্ম ও বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্বের ফারাক করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এ দেশের সাধুসন্তরা যে সনাতন হিন্দুধর্মে আস্থা রাখতেন, তাকে এক পেশিবহুল হিন্দুত্ব ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে, যা সব মাপকঠিতেই আইএসআইএস ও বোকো হারামের জেহাদি ইসলামের রাজনৈতিক রূপ।’
এই বক্তব্যকে হাতিয়ার করে বিজেপি নেতারা অভিযোগ তুলেছেন, সালমান খুরশিদ হিন্দুত্বের অবমাননা করেছেন। বিজেপি নেতা অমিত মালবীয়র যুক্তি, ‘যে দল মুসলিম ভোট পেতে ইসলামিক জেহাদের সাথে তুলনা টেনে গেরুয়া সন্ত্রাসের মতো শব্দ চালু করেছিল, সেই দলের একজন নেতার থেকে আর কী বা আশা করা যায়?’
খুরশিদ অবশ্য পাল্টা জবাবে বলেছেন, ‘যারা হিন্দুধর্মকে জানেন না, তাদের থেকেই এই রকম প্রতিক্রিয়া আসবে।’
বৃহস্পতিবার দিল্লিতে এই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে খুরশিদের সাথে কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম, দিগ্বিজয় সিংহরা অভিযোগ তুলেছেন, বিজেপি-আরএসএস রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য রাম জন্মভূমি আন্দোলনে নেমেছে।
সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় রামমন্দিরের পক্ষে রায় দেয়ার পরে বিজেপি তাকে নিজেদের সাফল্য বলে তুলে ধরার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন কংগ্রেস নেতারা।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায় ও সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে কংগ্রেসের নীতি নিয়ে যে মতভেদ রয়েছে, তা তিন নেতার বক্তব্যে ফুটে উঠেছে।
খুরশিদের মতে, সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার রায় অনেক ভেবেচিন্তেই দিয়েছে। আদালত যে মসজিদের জন্য জমি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে, সেটা অনেকে ভুলে যান। সেই দিক থেকে এই রায় ক্ষতে প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করেছে।
কিন্তু চিদম্বরমের যুক্তি, রামমন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায় দু’পক্ষ মেনে নিয়েছে বলেই সেই রায় সঠিক হয়ে গিয়েছে। উল্টোটা নয়। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের রায় সঠিক বলে তা দু’পক্ষ মেনে নেয়নি।
চিদম্বরম বলেন, ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’-র মতো এখন ‘কেউই বাবরি মসজিদ ভাঙেনি’ গোছের পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০০ জন অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত নেহরু, গান্ধী, এ পি জে আবদুল কালামের দেশের মানুষকে সব সময় তাড়া করবে।’
দিগ্বিজয় সিংহ বলেন, ‘অনেকেই অযোধ্যার রায়ে পরে চরম প্রতিক্রিয়া হবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু মানুষ বিরক্ত হয়ে ওই বিবাদ ছেড়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন।’
চিদম্বরম পাল্টা যুক্তিতে বলেন, ‘আপসের আগে সত্যিটা বলা দরকার। সত্যিটা হলো, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভয়ঙ্কর ভুল হয়েছিল। সেদিন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করা হয়েছিল। সংবিধানের অবমাননা হয়েছিল। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তা থেকে যে তিক্ততা তৈরি হয়, পরে তার সেতুবন্ধন কঠিন হয়ে যায়।’
চিদম্বরম বলেন, ‘দেশের প্রতিটি নাগরিককে ভাবতে হবে যে অযোধ্যার রায় সংবিধানের আত্মাকেই অসার করে দিয়েছে কি না।’
অন্যদিকে খুরশিদ নিজে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রশংসা করলেও বিজেপি যেভাবে রামমন্দিরের পক্ষে রায়কে নিজেদের সাফল্য বলে উৎসব করছে, তার সমালোচনা করেছেন।
দিগ্বিজয় বলেন, ‘১৯৮৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর গান্ধীবাদী সমাজবাদ ব্যর্থ হতেই মাত্র দু’টো আসনে জেতা বিজেপি রাম জন্মভূমিকে জাতীয় বিতর্ক করে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। গোঁড়া ধর্মীয় মৌলবাদের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা সমাজকে ভাগ করেছিল। তিনি যেখানে গিয়েছেন, ঘৃণার বীজ বপন করেছেন।’
হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুত্বের ফারাক প্রসঙ্গে খুরশিদের পাশে দাঁড়িয়েই দিগ্বিজয়ের মন্তব্য, ‘সাভারকর রাজনৈতিকভাবে হিন্দু পরিচিতি খাড়া করার লক্ষ্যেই হিন্দুত্বের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন। নিজে কিন্তু ব্যক্তিজীবনে ধর্মের ব্যাপারে খুব গোঁড়া ছিলেন না। গরুর গোশত নিয়ে তার সমস্যা ছিল না। গরুকে কেন গোমাতা বলা হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন।’
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা