নতুন কয়েক কোটি মানুষ ‘দারিদ্র্যের’ ঝুঁকিতে
রাজধানীর হাতিরপুলের একটি টাইলসের দোকানে কাজ করেন শফিকুল ইসলাম (৪০)। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায়। মহাখালী থেকে বাংলামোটরে বাসে ১০ টাকা করে আসা-যাওয়ায় ২০ টাকা খরচ হতো। গতকাল থেকে তাকে গুনতে হচ্ছে ১৫ টাকা করে দুই বারে ৩০ টাকা। শুধু বাসভাড়াতেই মাসে ৩০০ টাকার খরচ বেড়ে ৬০০ টাকা হওয়ায় তার মাথায় হাত। এর সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প বেতনের এই চাকরিজীবী।
নিজের দুঃখের কথা তুলে ধরে শফিকুল বলেন, ‘বাসাভাড়া বাড়ল, বাজারে সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, চাল, ডালসহ সব কিছুর খরচ বাড়ল; কিন্তু আমার আয় তো বাড়ল না। এখন সরকার আমাদের বেতনটা বাড়িয়ে দিক। ‘
তিনি বলেন, ‘বেতন বাড়ানোর কথা বলতে গেলে চাকরিতে ছাঁটাইয়ের মুখে পড়তে হবে। তাই সরকার আমাদের বেতন নির্ধারণ করে না দিলে আমাদের মতো মানুষের বেতন বাড়বে না, এই শহর ছেড়ে একদিন গ্রামে চলে যেতে হবে। ‘
সরকার জ্বালানি তেলের (ডিজেল ও কেরোসিন) দাম বাড়ানোয় চতুর্মুখী চাপে পড়েছে শফিকুলের মতো কোটি মানুষ। এর অভিঘাত পড়েছে করোনা মহামারিতে ‘নতুন দরিদ্র’ তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক, উৎপাদক, চাকরিজীবীসহ স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়ক পরিবহনের ভাড়া ২৭ শতাংশ এবং নৌপরিবহনের ভাড়া ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। দেশে নতুন করে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এই চরম দুর্দিনে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে দ্রব্যমূল্য আরেক দফা বৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে যাবে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন দিশাহারা, ঠিক তখনই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে মানুষের যাতায়াত, পণ্য পরিবহন, খাদ্যপণ্য ও কৃষিজ উৎপাদনসহ সামগ্রিক ব্যয় আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। আরো এক দফা বৃদ্ধির ফলে চরমভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। এতে নতুন করে আরো কয়েক কোটি মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা আছে। ‘
বেসরকারি সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬.৩১ শতাংশ। দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এই ধারা চলতি বছর আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজারে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দামে আগুন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এখন দাবানলে পরিণত হচ্ছে। বাসের ভাড়া বাড়ছে, লঞ্চের ভাড়া বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়ছে। এতে যে যেভাবে পারবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। তাই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি। ‘
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। কমবে ভোগ ব্যয়। সংকুচিত হবে অর্থনীতি। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘যে হারে জ্বালানি মূল্য বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় বেশি বেড়েছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান বাড়বে। ডিজেল যেহেতু এনার্জি সোর্স, কাজেই অনেক জায়গায় খরচ বাড়বে। এশিয়ার সব দেশের মধ্যে আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি। এর মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। ‘ তিনি এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিতরণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপে বলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জরিপে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। করোনাকালে দারিদ্র্যের কারণে ২৮ শতাংশ মানুষ শহর থেকে গ্রামে চলে যায়। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ এখনো শহরে ফিরতে পারেনি। শহর অঞ্চলের মানুষের আয় কভিডপূর্ব সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। গ্রামাঞ্চলে এ আয় কমেছে ১২ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, মানুষের খাদ্যের ক্ষেত্রে ব্যয় কোভিডকালের তুলনায় কমে গেছে। শহরে দরিদ্র মানুষের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৬৫ টাকা। এখন তা ৫৪ টাকা। গ্রামে ব্যয় ছিল ৬০ টাকা, এখন ৫৩ টাকা। শুধু খাদ্যই নয়, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ব্যয়, শিক্ষা ও যোগাযোগ খাতে দরিদ্র মানুষের ব্যয়ও বেড়েছে। এ বছরের মার্চ মাসে শহরের বস্তিতে এ ব্যয় ছিল ৯৩৬ টাকা। গ্রামে এসংক্রান্ত ব্যয় ৬৪৭ টাকা থেকে বেড়ে হয় ৭৭৭ টাকা হয়েছে। বাড়তি এসব ব্যয় মেটাতে গ্রামে ৬২ শতাংশ, শহরে ৬০ শতাংশ মানুষকে ঋণ করতে হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে আসে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, আয় কমে যাওয়ায় ৫২ শতাংশ মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। আবার অনেকের ঋণ বেড়েছে। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে তাদের আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যবধান আরো বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।