পরিবহন ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য, যাত্রীদের মাঝে চরম ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে
ডিজেলের মূল্য লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর কারণে পরিবহন ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার কর্তৃক ঘোষিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে গতকাল বেশি ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে শ্রমিকদের বাকবিতণ্ডার ঘটনা ঘটেছে। শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে বেশি ভাড়া আদায় করছে। এ নিয়ে যাত্রীদের মাঝে চরম ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে। পরিবহন ভাড়া বিশেষ করে বাস ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করার মত কেউই নেই। বিআরটিএ কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া ঠিক করলেও বাসগুলো এই হিসাবের ধারও ধারছে না। একটি নির্ধারিত গন্তব্য পর্যন্ত যে হারে ভাড়া নির্দিষ্ট করা ছিল, তার সঙ্গে ৫ বা ১০ টাকা বা আরও বেশি যোগ করে আদায় করা হচ্ছে।
রবিবার বাস ও লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তের পর মালিক সমিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা ধর্মঘট তুলে নেয়। পরে রাতেই শহরে বাস চলাচল শুরু করে। এরপর থেকেই বাড়তি ভাড়া নেয়ার হিড়িক শুরু হয়। ডিজেল, পেট্রোলের গাড়িসহ গ্যাস চালিত বাস থেকেও বর্ধিত ভাড়া নেয়া হয়। এ নিয়ে সোমবার দিনভর রাজধানীতে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সড়কে চলছে ভাড়া-নৈরাজ্য। নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সাধারণ যাত্রীদের মাঝে। গতকাল সোমবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করে যাত্রীবান্ধব ভাড়া পুনঃনির্ধারণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
ফার্মগেট থেকে মিরপুরের ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। গতকাল থেকে বাসে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। এ নিয়ে এই সড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের সঙ্গে দিনভর কথা কাটাকাটি হয়। কোন কোন বাসে যাত্রী ও চালকের সহকারীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। আবার গুলিস্তান থেকে মিরপুরের ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। গতকাল গুলিস্তান থেকে মিরপুর পর্যন্ত ৩৫ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
মিজান নামের এক যাত্রী বলেন, ১৫ টাকা দিয়ে অনেকদিন ধরে চলাচল করছি। ভাড়া বাড়ালে ২ টাকা বাড়ানো যায়। কিন্তু ৫ টাকা বাড়ানো মানে অনেক বেশি। ফার্মগেট থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ছিল আগে ৫ টাকা। এখন সেটি করা হয়েছে ১০ টাকা। যাত্রীদের অভিযোগ ৫ টাকার ভাড়া ১০ টাকা হলে শতভাগ ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
কাওরানবাজার থেকে গুলিস্তানের ভাড়া ছিল ১০ টাকা। গতকাল সেটি হয়েছে ১৫ টাকা। কাওরানবাজার থেকে গুলিস্তানগামী প্রত্যেকটি গাড়িতে ১৫ টাকা থেকে শুরু করে ২০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। সমানতালে ডিজেল, পেট্রোল ও গ্যাসচালিত গাড়িতে ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এতেকরে যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
শাহনাজ নামের এক যাত্রী বলেন, এই রুট দিয়ে আমি নিয়মিত যাতায়াত করি। বিভিন্ন কোম্পানির বাসে ১০ টাকা ভাড়া দিতাম। কিন্তু এখন ৫০ শতাংশ বেশি ভাড়া নিচ্ছে বাসে। সরকারতো এত টাকা বৃদ্ধি করে নাই। অথচ বাসে তাদের ইচ্ছেমত ভাড়া নিচ্ছে। কিবরিয়া নামের এক যাত্রী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফার্মগেট থেকে শ্যামলী কলেজগেট পর্যন্ত বাস ভাড়া দিতাম ১০ টাকা। বর্ধিত ভাড়ার কথা বলে এখন নেয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। এরককম পরিস্থিতি চলছে আমাদের মত সাধারণ যাত্রীরা কোথায় যাবে।
দূরপাল্লার বাসের যাত্রীরা বলছেন, মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ভাড়া বাড়াটা খুবই অসুবিধার। গণপরিবহণে বাড়তি ভাড়া কার্যকরের প্রথম দিনেই দেশের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয়েছে চরম নৈরাজ্য। যে যার মত আদায় করছে বাড়তি ভাড়া। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। তাদের অভিযোগ, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে পরিবহণ শ্রমিকরা। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় করছে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। একই চিত্র রাজশাহীতেও। মালিক-শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো নিজেদের নির্ধারণ করা ভাড়া আদায় করছেন। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বচসার ঘটনাও ঘটেছে। আগে রাজশাহী থেকে নাটোরের ভাড়া নিত ৫০ টাকা কিন্তু এখন নিচ্ছে ৮০ টাকা। এরকম চিত্র খুলনা, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, কুষ্টিয়া, বগুড়া, কুমিল্লাসহ অন্যান্য জেলায়।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ৩৬ টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৫০ টাকা। এই রুটে আগে ভাড়া ৩৬ টাকা থাকলেও ১৪ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা আদায় করছেন তারা।
সিএনজিচালিত বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘সিএনজির সিলিন্ডার তো গাড়িতেই থাকে। যাত্রীরা একটু কষ্ট করে দেখে নিয়ে তারপর ভাড়া দিলেই হয়।’ যাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা যখন ভাড়া দেবেন অবশ্যই একটু দেখে নিয়েন, বাসটি সিএনজিচালিত না ডিজেলচালিত। এরপর ভাড়া দেবেন।’ এটা যাত্রীদের দায়িত্ব কি না, এমন প্রশ্নে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজধানীতে অসংখ্য পরিবহন রয়েছে। চাইলে বিআরটিএ’র একার পক্ষে বাড়তি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমরা মাঠে আছি। এই কাজে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যাত্রীদের থেকে বাড়তি ভাড়া নিলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে সিএনজিচালিত বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করলে আইন অনুযায়ী জরিমানা ও মামলা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিআরটিএ চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এই কথাটি বলছেন। দায়িত্বটি সরকার তথা বিআরটিএর। যে বিআরটিএ ভাড়া নির্ধারণ করবে, তাকেই নির্ধারণ করে দিতে হবে কোন বাসটি সিএনজিচালিত, কোন বাসটি ডিজেলচালিত।’