চাপ বাড়বে জীবনযাত্রায়

0

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি

আমজনতা চাপে

পনেরো টাকা তেলের দাম

বাড়ল এক লাফে।

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশের বহু মানুষ অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। অনেক মানুষ তাদের ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে দরিদ্র হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়সক্ষমতা কমেছে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি পরিস্থিতি আরও নাজুক করে তুলেছে। সাধারণ মানুষ তাদের ব্যয় বহন করতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। ঠিক এমনই এক ক্ষণে ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়ানো হলো। একইভাবে এলপি গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটারে ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এ দাম সমন্বয় করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে কিছুটা কমানো হয়েছিল; তবে আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে কমেছিল, সেভাবে কমানো হয়নি। ২০১৬ সালে জ্বালানি তেলের দাম পুনঃনির্ধারণের সময়ও দেশীয় বাজারে জ্বালানির দাম বেশি ছিল আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায়। বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির বেশিরভাগই পরিশোধিত। অপরিশোধিত জ্বালানি আমদানি করলে দামে সাশ্রয় হতো।

মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে এ দাম বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন লিকুইফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দাম সিলিন্ডারপ্রতি ৫৪ টাকা বাড়িয়েছে। কমিশন থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে সৌদি আরবে দাম বৃদ্ধির কারণে সব ধরনের গ্যাসের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এ দাম বাড়ানোর ফলে বেসরকারি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন করসহ প্রতি কেজি এলপিজির দাম ১০৪ টাকা ১২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০৯ টাকা ৪২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যে কারণে বাজারে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১২৫৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩১৩ টাকা করা হয়েছে; অর্থাৎ ৫৪ টাকা বেড়েছে।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার অথবা ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে সারা দেশে পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা। তাদের এ ধর্মঘট অনির্দিষ্টকাল চলবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। এ ধর্মঘটে জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছিল। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেই বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের দাম। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এতে করে পরিবহণ ও কৃষি ব্যয় বাড়বে এবং প্রভাব পড়তে পারে বিদ্যুতের দামেও। সব মিলিয়ে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের-

বাড়ছে দাম, ঝরছে ঘাম

ধার নাহি কেউ ধারে

সব ঝামেলা পড়ে গিয়ে

আমজনতার ঘাড়ে।

করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকে আবার ব্যবসায় লোকসান গুনেছেন। এর ফলে আয় কমে গেছে দেশের বড় একটি অংশের মানুষের। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপে বলা হয়েছে, দেশে করোনাকালে নতুন দরিদ্র ৩ কোটি ২৪ লাখ। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এসব গরিব মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশেও সেটির প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কমে যায়, তখন এখানে দাম কমানোর বিষয়টি দৃশ্যমান নয়। যদিও সে সময়ে অনেক দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। এ ছাড়াও দেশে পেট্রোল ও অকটেন আমদানির ওপর চাপ অনেক কমে গেছে। দেশেই এখন অকটেন ও পেট্রোল তৈরি করা হচ্ছে এবং সেটি বিক্রি করে অর্থ আয়ের সুযোগও বাড়ছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের গণশুনানির যে আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, সেটি অনুসরণ করা উচিত ছিল। যা হোক, জনগণ মনে করে, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই পরিস্থিতির মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পরিবহণ ব্যয় বাড়বে, পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। পণ্যের ব্যয় বৃদ্ধিসহ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপক চাপে পড়বে। ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। দেশে এখনো অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিজেলচালিত। আর এর ফলে বিদ্যুতের খরচও বেড়ে যাবে। সেচ কাজে ডিজেলের ব্যাপক ব্যবহার হয়, যার ফলে কৃষির ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে। বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন এবং এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৫০ লাখ টন, যার মধ্যে ৪০ লাখ টন আমদানি করা হয়। ডিজেলের মোট চাহিদার ৬৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পরিবহণ খাতে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ২৬ শতাংশ ফার্নেস অয়েল ও ৬ শতাংশ ডিজেলচালিত কেন্দ্র। জ্বালানি তেলের ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিতে। এর ফলে কৃষিতে বাড়বে সেচ ব্যয়। সরকার জ্বালানি তেলে বিগত বছরগুলোতে বেশ মুনাফা করেছে। গত কয়েক মাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আর এতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো।

ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কেরোসিনের দামও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে কেরোসিননির্ভর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর এর প্রভাব পড়বে। ভোক্তা অধিকার সংস্থা (সিসিএস) তেলের দাম কমিয়ে সহনশীল পর্যায়ে আনার দাবি জানিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে অনেক খাতের ব্যয়ও বেড়ে যাবে। কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য এবং সেবার মূল্য বেড়ে যাবে। একটি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে সেটির সঙ্গে অনুষঙ্গ পণ্যগুলোর মূল্য বেড়ে যায়, যেটির ভার বহন করতে হয় সাধারণ মানুষকে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে দেশীয় পণ্য রপ্তানি প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। গত প্রায় ৮ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম ছিল। অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪০ ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু দেশে সে সময়ে তেলের দাম কমানো হয়নি।

জ্বালানি তেলের দামের বিষয়টি সরাসরি জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যতবার তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, ততবার এর ধকল সহ্য করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। বিগত বছরগুলোয় দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে কার্যকরভাবে সমন্বয় করা গেলে লাভবান হতো দেশের শিল্পখাত। যা হোক, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, তা সাময়িক। করোনা সংক্রমণ হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী মানুষের চলাচল বেড়েছে; ফলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তেলের দাম আবার কমে আসতে পারে।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর থেকে জনজীবনে অস্বস্তি বিরাজ করছে। দুঃসময়ে জীবনযাত্রায় আরও চাপ বেড়ে যাচ্ছে। কবির ভাষায় বলতে হয়-

বাজার এমন গরম হলে

কী করবে দেশবাসী

চোখের জলে সিক্ত হবে

ম্লান হবে হাসি।

বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষের কঠোর পরিশ্রমে আর সঠিক নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক রোল মডেল। কিন্তু সাধারণ মানুষের কষ্টগুলো সম্পর্কে সবার আগে ভাবতে হবে।

করোনা মহামারি কিছুটা কমে যাওয়ায় অর্থনীতি যখন চাঙ্গা হতে শুরু করেছে, তখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে চাপ বাড়াবে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৫ শতাংশ বাড়ানো কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে, তা সরকার পুনরায় ভাববে বলে মানুষ বিশ্বাস করে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণসহ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সরকার আরও গভীরভাবে ভাববে এবং বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নেবে বলে জাতি আশা করে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com