বাড়তি ভাড়ায় নৈরাজ্য ক্ষুব্ধ যাত্রীরা

0

গণপরিবহণে নতুন ভাড়া কার্যকরের প্রথম দিন সোমবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর সড়কে চরম নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। কোনো বাসেই সরকার নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চার্ট দেখা যায়নি। এ দুই স্থানে সরকার নির্ধারিত হার অনুযায়ী নয়, মালিকদের দেওয়া চার্টে ভাড়া আদায় করেছে পরিবহণ শ্রমিকরা। সরকার কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করেছে ‘ওয়েবিল’ অনুযায়ী।

এতে রুটভেদে ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়েছে যাত্রীদের। এমনকি সিএনজিচালিত বাসেও একই হারে ভাড়া নেওয়া হয়। যদিও সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী এসব বাসে আগের ভাড়াই নেওয়ার কথা। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ যাত্রীরা ছিলেন রীতিমতো অসহায়। কারণ অধিকাংশ সময়ে ‘নীরব দর্শকের ভূমিকায়’ ছিলেন ট্রাফিক পুলিশ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ম্যাজিস্ট্রেটরা।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় রোববার দূরপাল্লার রুটে ২৭ শতাংশ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত বাসে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ায় বিআরটিএ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে মিনিবাসের ভাড়া ৫ থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ও বাসের ভাড়া ৭ টাকার স্থলে ১০ টাকা করা হয়। অপরদিকে লঞ্চের ভাড়া ৩৫ শতাংশ বাড়ায় বিআইডব্লিউটিএ।

সোমবার থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর করা হয়। এতে দূরপাল্লার রুটভেদে যাত্রীপ্রতি বাস ও লঞ্চে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা বলেছেন, বাস, মিনিবাস, টেম্পোতে ভাড়া নৈরাজ্য চলছে। নতুন ভাড়া কার্যকরের নামে রাজধানী ও চট্টগ্রামে চলাচলকারী বাস কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো যাত্রীদের পকেট কাটছে। কোথাও ভাড়ার চার্ট টানানো হয়নি। মালিকদের ওয়েবিল অনুযায়ী ভাড়া আদায় করছে। এ নিয়ে যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকদের কথা কাটাকাটি ও মারধরের মতো ঘটনাও ঘটেছে। তারা আরও বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণে মানুষ এমনিতেই আর্থিক সংকটে রয়েছেন। এর মধ্যে নতুন ভাড়া যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।’

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে উল্লিখিত চিত্র। গণপরিবহণের নৈরাজ্য দেখার কেউ নেই-এমন অভিযোগ করেন রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. আব্দুছ ছাত্তার। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত আলিফ পরিবহণ ও ভূঁইয়া পরিবহণের বাসে যাত্রীপ্রতি ৫৫ টাকা ভাড়া আদায় করেছে। আগে তা আদায় করা হতো ৪০ টাকা। তিনি আরও জানান, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর উত্তরা পর্যন্তও দূরত্বের বাসযাত্রীদের একই ভাড়া দিতে হয়। তার প্রশ্ন-এই স্থানগুলো কি একই দূরত্বের। এ নিয়ে কথা বললেই হেলপাররা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, গণপরিবহণে নৈরাজ্য চলতে দেওয়া হবে না। বাড়তি ভাড়া আদায় করছে কিনা-তা দেখার জন্য ঢাকায় ১০টি ও চট্টগ্রামে তিনটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটরা মূলত কোনটা সিএনজি ও ডিজেলচালিত বাস এবং তারা কী ধরনের ভাড়া নিচ্ছে তা দেখছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন চার্ট তৈরি হচ্ছে। এখনো তা পরিবহণসংশ্লিষ্টদের কাছে সরবরাহ করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে প্রথম দিনে কঠোর হচ্ছি না। তবে বাড়তি ভাড়া যাতে আদায় না করে সেজন্য সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, বিআরটিএর চার্ট অনুযায়ী গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দূরত্ব ৫ দশমিক ১ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ১৫ পয়সা অনুযায়ী এ পথের ভাড়া দাঁড়ায় ১১ টাকা। কিন্তু সাভার পরিবহণ, বিহঙ্গ, এয়ারপোর্ট পরিবহণসহ সব কোম্পানির বাসে আদায় করা হয়েছে ১৫ টাকা। মিনিবাসে এ দূরত্বের ভাড়া ১০ টাকা ৪৫ পয়সা হলেও সেগুলোতে একই ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। প্রেস ক্লাব বা শাহবাগ থেকে উঠলেও ফার্মগেট পর্যন্ত ১৫ টাকা গুনতে হয়েছে যাত্রীদের।

এ বিষয়ে সাভার পরিবহণের হেলপার রিয়াজ বলেন, প্রেস ক্লাবে আমাদের ওয়েবিলে সই হয়। গুলিস্তান, পল্টন বা প্রেস ক্লাব থেকে যাত্রী উঠে প্রেস ক্লাবের পর শাহবাগ, কাওরান বাজার বা ফার্মগেট যেখানেই নামুক ১৫ টাকা ভাড়া নিচ্ছি। কারণ বাসে কতজন যাত্রী রয়েছে তা ওয়েবিলে লিখে দেন সুপারভাইজার। ওই সংখ্যা অনুযায়ী টাকা মালিকদের দিতে হয়।

আরও দেখা গেছে, বাস ও মিনিবাসে একই ধরনের ভাড়া আদায় করা হয়েছে। এমনকি কোন গাড়ি ডিজেলে, আর কোন গাড়ি সিএনজিতে চলে-তাও আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। আর সেই সুযোগটাই নিয়েছে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকরা। যাত্রীরা প্রতিবাদ করলে বলা হচ্ছে, তাদের গাড়ি তেলে চলে। এছাড়া রাজধানীর কোনো কোনো রুটের বাসগুলোতে ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়েছে। সাভার ও বসুমতি পরিবহণে গুলিস্তান থেকে গাবতলী আগে ২৫ টাকা নিলেও গতকাল আদায় করেছে ৩০ টাকা। গুলিস্তান থেকে সাভার আগে ৫০ টাকা ভাড়া নিলেও গতকাল নিয়েছে ৬০ টাকা। একইভাবে অন্যান্য রুটের বাসগুলোতেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ৩৬ টাকা থেকে ভাড়া বাড়িয়ে ৫০ টাকা আদায় করেছে পরিবহণ শ্রমিকরা। বাস মালিকরা কাউন্টারের সামনে চার্ট টানিয়ে দিয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব অনুসারে বিআরটিএর নির্ধারিত ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসেবে জনপ্রতি ৪৩ টাকা এবং হানিফ ফ্লাইওভারের জন্য জনপ্রতি ৭ টাকা করে টোল দিতে হবে। এ নিয়ে জনপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ টাকা। উৎসব পরিবহণ ও বন্ধন পরিবহণের বাসে ৫০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। হিমাচল আদায় করেছে জনপ্রতি ৪৫ টাকা ও বিআরটিসির বাসে তা ৪০ টাকা।

এ বিষয়ে উৎসব পরিবহণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজল হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া পয়েন্ট থেকে ঢাকা জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত দূরত্ব ১৭.৯ কিলোমিটার। কিন্তু আমাদের গাড়িগুলো নারায়ণগঞ্জের মেট্রো সিনেমা হল ঘুরে রেলগেট বাসস্ট্যান্ডে যায়। ওখান থেকে যাত্রী নিয়ে চাষাঢ়া হয়ে ঢাকায় আসে। সেই দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নিচ্ছি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, বিআরটিএ কর্মকর্তা ও পরিবহণ মালিকদের সঙ্গে বসে অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়টি মঙ্গলবার ফয়সালা করা হবে। এরপরও ভাড়া নিয়ে সমস্যা হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।

দূরপাল্লার বাসে ভাড়া বেড়েছে ২০০ টাকা পর্যন্ত : গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে আগের চেয়ে ভাড়া বেড়েছে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। পরিবহণসংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন ভাড়া কার্যকর করা হয়েছে। তবে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না। অন্যান্য সময়ে ভাড়া কম নেওয়া হলেও এখন সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া আদায় করা হয়। এ কারণে সাধারণ মানুষের কাছে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হানিফ পরিবহণের বাসে দিনাজপুর ৭৯০ টাকা, রংপুর ৭৪০ টাকা এবং রাজশাহী ৬০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত ৩৩০ কিলোমিটার দূরত্বের এ পথে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৭৯৩ টাকা। আগে এ ভাড়া ছিল ৫৯০ টাকা। ঢাকা থেকে ৩০৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রংপুরের ভাড়া আগে ছিল ৫৮৯ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৪১ টাকা। ঢাকা-সিলেট রুটে আগে সরকারি ভাড়া ছিল ৪৫৪ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯৭ টাকা। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ২৪২ কিলোমিটার দূরত্ব। এ রুটের ভাড়া ৪৪২ থেকে বেড়ে ৫৬৫ টাকা হয়েছে। অন্য রুটগুলোতেও একইভাবে ভাড়া বেড়েছে।

লঞ্চেও বেড়েছে ভাড়া : পুরান ঢাকা প্রতিনিধি জানান, নতুন ভাড়া কার্যকর করা হয়েছে লঞ্চেও। এতেও ভাড়া বেড়েছে ৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। সরেজমিন দেখা যায়, বরিশালগামী সুন্দরবন-১২, পারাবত-১০ লঞ্চের প্রতিটি সিঙ্গেল কেবিন এক হাজার ৪০০ টাকা ও ডাবল কেবিন দুই হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হয়। তাছাড়া ডেকযাত্রীদের কাছে ৩৫০ টাকা আদায় করা হয়। আগে ডেকের ভাড়া ২৫০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন এক হাজার টাকা ও ডাবল কেবিন দুই হাজার টাকা ভাড়া ছিল।

ঝালকাঠিগামী লঞ্চের কেবিনযাত্রী রফিকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা লঞ্চ মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। আমি অসুস্থতা নিয়ে ৫ দিন আগে ঢাকা আসার সময় দুই হাজার ২০০ টাকায় ডবল কেবিনে এসেছি। আজ (সোমবার) ওই কেবিনের ভাড়া দুই হাজার ৮০০ টাকা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ যুগ্ম-পরিচালক জয়নাল আবেদিন বলেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ কারণে আগের চেয়ে ভাড়া বেড়েছে। তাই যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করছেন।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com