গড়ে উঠছে দেশে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়: শিক্ষা নয়, লক্ষ্য যেন হালুয়া রুটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক একটি পুরান বিষয়। নিয়মনীতির আলোকে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। আগে দলীয়করণের একটি অভিযোগ থাকলেও অন্ততপক্ষে মেধাবীদের মধ্যে থেকে সেটা হতো; দুর্ভাগ্য ক্রমে সেই ধারাও থাকেনি। সর্বশেষ প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে- দলীয়করণের সাথে আত্মীয়করণ মিলে একেবারে অমেধাবী ও পেছনের কাতারের ছাত্ররাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। বর্তমান সরকারের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে আরো নিম্নমানের দুর্নীতি হতে দেখা যাচ্ছে। শুধু নিয়োগ পদায়নে অনিয়ম-দুর্নীতি আত্মীয়করণ নয়, এবার শিক্ষকদের দেখা গেল ভবন নির্মাণ নিয়ে চাঁদাবাজির সাথেও জড়িয়ে যেতে। সহযোগী একটি দৈনিকের খবরে দেখা যাচ্ছে, নবগঠিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা নিয়োগে চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চক্র স্বজনদের নিয়োগ দিচ্ছে, আবার অর্থের বিনিময়েও নিয়োগ দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন গোলাম সরোয়ার। এরপর তিনি নিজের ভগ্নিপতিকে সেকশন কর্মকর্তা, এক ফুফাত ভাইকে স্টোর কর্মকর্তা, আরেকজনকে গাড়িচালক এবং ভাতিজি জামাইকে বানিয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক শিবলী মাহবুবের স্ত্রী পেয়েছেন সেকশন কর্মকর্তার চাকরি ও শ্যালক হয়েছেন চিত্রগ্রাহক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের প্রভাষক রওশন আলমের ভাই, ভাবি ও চাচাতো ভাইও চাকরি পেয়েছেন। খবরের বিবরণে জানা যাচ্ছে, এই তিনজনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সোহরাব আলী গড়ে তুলেছেন একটি চক্র। চারজন মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করেন। আত্মীয়করণের সাথে এ চক্রের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে চাকরি দেয়ার অভিযোগ এসেছে। বিভিন্ন পদে দফায় দফায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ জন্য আট থোক ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হওয়ার খবর রয়েছে।
নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের আত্মীয় ও দলীয় সদস্যরাও রয়েছেন। মোট কথা, সবাই মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে সেখানে নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো নির্মাণ হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর চার বছরে ৫৫ কর্মকর্তা ও ১৪৪ কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পত্রিকাটি একই দিন নতুন প্রতিষ্ঠিত সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের খবর দিয়েছে। এটির যাত্রা ২০১৮ সালে। ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এখনো শুরু হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম। তবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১৭৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের বসার জায়গাও নেই। এসব নিয়োগেও একই ধরনের আত্মীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। দুর্নীতির বিস্তারিত যে সয়লাব তাতে শিক্ষার লক্ষ্য প্রতিফলিত হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে আমরা কেবল বাণিজ্যের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছি। এগুলো করছি শুধু চাকরি করতে শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে নয়।
উপরে উল্লেখিত দুটি নবগঠিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতির কথা আমরা তুলে ধরলাম। দেশে এখন অর্ধশতের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর বিরাট একটি অংশ বড় বাজেটে কার্যক্রম শুরু করেছে। অনেক বিশেষ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্পের শুরু থেকে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এগুলোর দুর্নীতি সামাল দিতে গিয়ে ইউজিসি দিশেহারা। ভিসি নিয়োগ থেকে এ দুর্নীতির শুরু, পিয়ন নিয়োগও এর বাইরে থাকছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার সর্বোচ্চস্তরে এ অবক্ষয় হওয়া মানে, মাথা থেকে জাতীয় জীবনে পচন ধরেছে। এ জন্য আমরা যদি নিচের স্তরের কিছু অপরাধীকে চাকরিচ্যুত করি; তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। গলদটির মূল জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে একেবারে উপর থেকে। অন্যথায় আমাদের জাতীয় জীবনের পতন রোধ করা যাবে না।