২০৩০ সালের মধ্যেই বন নিধন বন্ধ
কপ২৬ শীর্ষ জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও পৃথিবী রক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। একদিনেই ঐতিহাসিক দুই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অর্থাৎ আগামী ৯ বছরের মধ্যে বন নিধন বন্ধের ওয়াদা করেছেন বিশ্বনেতারা।
শুধু তাই নয়, লক্ষ্য বাস্তবায়নে বড় অঙ্কের (১ হাজার ৯২০ কোটি ডলার) একটি তহবিল গড়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এদিকে ২০৩০ সালের মধ্যে শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস মিথেনের নির্গমন ৩০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নেতৃত্বাধীন এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বিশ্বের অন্তত ৯০টি দেশ।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন স্থানীয় সময় মঙ্গলবার প্রথম বন নিধন বন্ধ সম্পর্কিত চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে এটাই প্রথম কোনো বড় সমঝোতা।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে এ বলে সতর্কও করেছেন যে, বনভূমি উজাড়ের গতি মন্থর করতে ২০১৪ সালের একটি চুক্তিও কার্যত ব্যর্থ হয়েছে এবং নতুন অঙ্গীকার পূরণে বিশ্বনেতাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
কার্বন ডাই-অক্সাইডের পর মিথেনই পরিবেশ বিপর্যয়কারী অন্যতম প্রধান উপাদান। কার্বন ডাই-অক্সাইডের তুলনায় বায়ুমণ্ডলের তাপ শোষণকারী আস্তরণকে দ্রুত গলিয়ে ফেলতে সক্ষম মিথেন। যে কারণে এই গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন হ্রাসই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির লাগাম দ্রুত টেনে ধরতে পারে।
কপ২৬ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে তাই মিথেনের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বিশ্বনেতারা। বাইডেন প্রশাসনের এক কর্মকর্তার মতে, ‘দ্য গ্লোবাল মিথেন প্লেজ’ নামের এই চুক্তির ব্যাপারে গত সেপ্টেম্বরে প্রথম ঘোষণা দেওয়া হয়।
বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ৩০ মিথেন নির্গমনকারী দেশের অর্ধেক এই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ মিথেন নির্মগনকারী দেশের অন্যতম ব্রাজিলও এই চুক্তিতে আছে। তবে মিথেন নির্গমনকারী শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্তর্ভুক্ত চীন, রাশিয়া এবং ভারত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
চুক্তি দুটি নিয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা আশাবাদী হলেও আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনের পরিচিত মুখ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আসলে আন্তরিক হওয়ার ভান করছেন রাজনীতিকরা। এ সম্মেলন থেকেও শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর এক পয়সারও উপকার হবে না।
গ্লাসগো শহরে চলমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের মধ্যে সোমবার এক বিক্ষোভে তরুণ বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন তিনি।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ আয়োজিত এক বিক্ষোভে অংশ নিয়ে গ্রেটা বলেন, ‘প্রকৃত পরিবর্তন সম্মেলনে উপস্থিত রাজনীতিকদের হাত ধরে আসবে না। আমাদেরকেই নেতৃত্ব হাতে তুলে নিতে হবে। তবেই পরিবর্তন আসবে।’
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন স্পষ্ট। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে নিয়মিতভাবে দাবদাহ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও।
এছাড়া বনের গাছ কেটে ফেললে সেটিও জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। কারণ গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিপুল পরিমাণে বন উজাড় হলে বায়ুতে ক্ষতিকর এ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়।
‘গ্লাসগো লিডারস ডিক্লারেশন অব ফরেস্ট অ্যান্ড ল্যান্ড ইউজ’ শীর্ষক বন নিধন বন্ধের এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে কানাডা, রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ও ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো। পৃথিবীর মোট বনভূমির প্রায় ৮৫ শতাংশই এই চার দেশে রয়েছে।
আমাজন বনের বড় অংশ কেটে ফেলা হয়েছে ব্রাজিলে। সেই ব্রাজিলও প্রতিশ্রুতি দানকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। চুক্তির ব্যাপারে সম্মেলনের আয়োজক ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ১১০টির বেশি দেশ ঐতিহাসিক এ চুক্তিতে একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বন নিধনের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এখনই বন্ধ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রকৃতির ওপর বিজয়ী হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এখন বিজয়ীর বদলে আমাদের এই রক্ষক হতে হবে।
বিশ্বের নিচু ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোসহ জলবায়ুপীড়িত দেশগুলোর জন্য ‘কোয়ালিশন ফর ডিজাস্টার রিজিলিয়েন্ট ইনফ্রাসট্রাকচারস স্মল আইল্যান্ড ডেভেলপিং স্টেটস’ নামে মোটা অঙ্কের একটি তহবিল গড়ার ঘোষণাও দিয়েছেন বরিস।
২০৪৫ সাল নাগাদ কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনবে জার্মানি : জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল বলেছেন, তার দেশ ২০৪৫ সাল নাগাদ কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনতে চায়।
সোমবার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ঐতিহাসিক জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে এমন মন্তব্য করেন তিনি। মার্কেল বলেন, জলবায়ু সুরক্ষায় অন্যান্য উন্নত দেশের মতো জার্মানিরও একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
এ কারণেই আমরা নির্গমন হ্রাসের জন্য আরও কঠিন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। ২০৪৫ সাল নাগাদ আমরা জলবায়ু নিরপেক্ষ হতে চাই।
সম্মেলনের মাঝেই ঘুম, বক্তব্য না শুনেই তালি দিলেন বাইডেন : কপ২৬ সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্য চলাকালে বারবার ঘুমিয়ে পড়ছেন জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্টের এ দৃশ্যটি মঙ্গলবার বেশ সাড়া ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ভিডিওতে দেখা যায়-মাস্ক পরিহিত অবস্থায় বসে আছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। বক্তব্য শুনতে শুনতে বারবারই ঘুমিয়ে পড়ছেন। পরে আবার জেগে উঠে বক্তব্য শুনছেন। আবার ঘুমিয়ে পড়ছেন।
একপর্যায়ে এক কর্মী এসে তার কানে কানে কী যেন বললেন। এরপর তিনি জেগে উঠে চোখ কচলাতে থাকেন। ততক্ষণে বক্তব্যও শেষ হয়ে গেছে। অন্যদের দেখাদেখি তিনিও করতালি দিতে শুরু করেন!
জলবায়ু মোকাবিলায় ৫ প্রতিশ্রুতি মোদির : বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে তথা উষ্ণায়নের মাত্রা হ্রাস করতে ৫ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। সোমবার গ্লাসগোর মঞ্চে দাঁড়িয়ে এসব প্রতিশ্রুতি দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বলেন, ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন দূষণের মাত্রা পুরোপুরি কমিয়ে ফেলার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে ভারত। সব মিলিয়ে মোট ৫টি প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বের কাছে ভারতের ‘পঞ্চমৃতের উপহার’ বলেও বর্ণনা করেছেন তিনি।
১৭ হাজার কোটি টাকা দান করবেন বেজোস : মহাকাশ ভ্রমণের সময় তিনি প্রকৃতির ভঙ্গুর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন আমাজন প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। আর এ অবস্থা ঠিক করতে তিনি ২০০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকারও বেশি। গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে মঙ্গলবার বেজোস বলেন, এ অর্থ বেজোস আর্থ ফান্ড থেকে ভূমি বিন্যাস এবং খাদ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনে বরাদ্দ দেওয়া হবে।
অবশেষে সম্মেলনে সেই ‘হুইলচেয়ার মন্ত্রী’ : শেষপর্যন্ত হুইলচেয়ার চলার রাস্তা তৈরি করল কপ২৬ কর্তৃপক্ষ। সে রাস্তা ব্যবহার করে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের সঙ্গে দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী কারিন এলহারার মঙ্গলবার জাতিসংঘের কপ২৬ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন।
সোমবার হুইলচেয়ারের রাস্তা না থাকায় ফিরে যেতে হয়েছিল কারিনকে। বিতর্কিত এ ঘটনার জন্য সেদিনই আয়োজকদের কাছে অভিযোগ করে ইসরাইল। যদি কারিন এলহারার সম্মেলনে যোগ দিতে না পারেন তাহলে প্রধানমন্ত্রীও মঙ্গলবার যোগ দেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দেয় ইসরাইল।