জনগণের প্রতি দয়ামায়া নেই বলেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার: রিজভী
সরকার বর্গীদের মতো লুটপাট করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী।
তিনি বলেছেন, ‘বর্গীরা যেমন আগে লুট করতে বাংলাদেশে আসতো, পরে আবার চলে যেতো। এরাও ঠিক একইভাবে লুট করছে এবং বিদেশে তাদের বিত্ত তৈরি করছে এবং সেখানে দেশের সম্পদের পাহাড় গড়ছে।’
সোমবার (১১ অক্টোবর) দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রিজভী বলেন, ‘বর্তমানে দেশের মানুষের জীবন এক শাসরুদ্ধকর দু:সহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় লুটেরা দস্যুদের পায়ের তলে অশ্রুপাত করছে মানবতা। একদিকে স্বেচ্ছাচারী একনায়ক শাসকের শোষণে নিষ্পেষিত জনগণ, অপরদিকে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ উর্ধগতিতে অসহনীয় হয়ে উঠেছে জীবন যাপন। গতকাল শেখ হাসিনা বলেছেন- বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আসলেই তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মানুষের ওপর অসহনীয় ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন উর্দ্ধগতিতে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলে, তাক লাগিয়ে দিয়েছেন দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের সুযোগ করে দিয়ে, ব্যাংক লুটের সুযোগ করে দিয়ে। কিন্তু তথাকথিত উন্নয়নের তাস দিয়ে মানুষের মন জেতা যাবে না।’
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘করোনার অভিঘাতে মানুষের আয় রোজগারে যখন টানাপোড়েন অবস্থা, তখন হু হু করে বাড়ছে নিত্য পণ্যের বাজার দর। খাদ্যদ্রব্য, চাল, ডাল, তেল, লবণ, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, তরিতরকারী, মাছ-মাংশ, পোল্ট্রি মুরগি, ডিম, চিনি, দুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য দ্রব্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন এবং ক্রমে এসব পণ্য সংগ্রহ অসম্ভব হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর জন্য। এর পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিলও বৃদ্ধি করা হয়েছে পাল্লা দিয়ে। গতকালও এলপিজি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে আওয়ামী লীগের কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুতদার সিন্ডিকেট। আয়ের তুলনায় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উল্লম্ফন ঘটায় মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ নীরবে আর্তনাদ করছে। ঘরে ঘরে চলছে বোবা কান্না। সংসার চালানোই এখন দায় হয়ে পড়েছে। কিন্তু নিশিরাতের ভোট ডাকাত সরকার নির্লিপ্ত।’
বিএনপির এই মুখপাত্র বলেন, ‘ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় জনগণের প্রতি এই সরকারের কোনো রকম যে দায়িত্ব আছে সেটি তারা মনে করে না। জনগণের প্রতি তাদের কোনো দয়ামায়া নেই। তাই আজকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। কারণ এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে মধ্যস্বত্বভোগীরা যারা লাভবান হচ্ছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগার বা আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। বাজারে সরকারের কোনো নজরদারি নেই। তাদের নজর লুটপাটে। আর নিজেদের হরিলুট, ভয়াবহ দুর্নীতি ইত্যাদি অপকর্ম ঢাকতে বিএনপি ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বুনে চলছেন হাজার হাজার মিথ্যার জাল। ক্ষমতার নেশায় আচ্ছন্ন আওয়ামী সরকার ন্যায়নীতি ও জনকল্যাণের নির্দেশ গ্রাহ্য করে না।’
রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘বানিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রীরা নিজেরাই ব্যবসায়ী এবং এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। ‘খাদ্য উৎপাদন, আমদানি ও বাজার পরিস্থিতি প্রেক্ষিত খাদ্য অধিকার’ শীর্ষক সেমিনারে অধিকাংশ বক্তাই চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে খাদ্যমন্ত্রী ও তার নিয়ন্ত্রনাধীন রাইস মিলগুলোর ভূমিকাকে দায়ী করেন। মন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ব্যবসায়ীদের অতি লোভের কারণে মাঝে মাঝেই চালের দাম বাড়ে। ইতোপূর্বে ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর কথা বলা হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে চালের দাম এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। বলা হচ্ছে-বাংলাদেশ থেকে চাল রফতানী হচ্ছে, অথচ অব্যাহত চাল আমদানী চলছে একই সঙ্গে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম। বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের বড় ব্যবসায়ী। ভোজ্য তেল, পেঁয়াজের দাম নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। খবরের কাগজে বেরিয়েছে তলে তলে তারা সিন্ডেকেটে জড়িত। সিন্ডিকেট জনগণের পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছুর দাম এখন চড়া। বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম ৬০ টাকা। যা আগের চেয়ে কেজিতে বেড়েছে ৬-৭ টাকা। এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৫০ টাকা। কিছুদিন আগেও এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকায় কেনা যেত, এখন সেটা ১৭৫ টাকা। পেঁয়াজের দাম মোটামুটি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কোনো উৎসব বা উপলক্ষ নেই, তবু ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ টাকা ছুঁয়েছে, যা সাধারণত: ১২০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে থাকে। তেল, চিনি, পেঁয়াজে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে, ছুঁলেই শক করে। এ বছর ইলিশের দামও কমেনি। কারণ দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে প্রতিবেশী দেশে পাঠানো হয়েছে। সেখানে দাম কম, অথচ আমাদের দেশে আকাশছোঁয়া। সবজি রান্নার জন্য সামান্য ছোট চিংড়ি কিনতেও প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৬০০/৭০০ টাকা। করলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি, পটলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, ঢেঁড়শের কেজি পাওয়া যাচ্ছে ৬০ টাকায়, বরবটির কেজি পাওয়া যাচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। কাঁচামরিচের দামও অকল্পনীয়ভাবে বেড়েছে। দামে সেঞ্চুরী পার করেছে।’
রিজভী বলেন, ‘গত ১ মাসে গুঁড়াদুধের দাম কেজিতে বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ থেকে ৩০ টাকা। শিশুখাদ্যের মূল্যও একইভাবে বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন। এছাড়াও ডাল, চিনিসহ নিত্য ভোজ্যসামগ্রীর দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এই মূল্যবৃদ্ধি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন খোদ ব্যবসায়ীরাই। এর কোন প্রতিকার নেই। কে করবে প্রতিকার ? বাজার সিন্ডিকেটের দাপট দেখে মনে হয় সরকার ও প্রশাসন বাজার সিন্ডিকেটে পৃষ্ঠপোষক। এদেশের মানুষ ফৌত হয়ে গেছে, কিন্তু আওয়ামী রাজন্যবর্গ বিত্ত-বিলাসে মত্ত হয়ে আছে। অন্যদিকে দেশজুড়ে তারা সৃষ্টি করেছে অবিশ্বাস, অসহিষ্ণুতা ও বিদ্বেষের আবহ। এই সরকারের পতন ছাড়া জনগণের মুক্তি আসবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব বলেন, ‘শহীদ জেহাদের ৩২তম শাহাদাত বার্ষিকীতে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। ২০১৪ সাল কিংবা ২০১৮ সালের মতো জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে আর জোচ্চুরি-ডাকাতি-প্রতারণা করতে দেয়া হবেনা। জনদাবি মেনে নিয়ে ক্ষমতা জবরদখলকারী চক্র যদি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা মেনে নেয়, তাহলে একটি অবাধ-সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশে বিরাজমান সংকটের সমাধান। অন্যথায়, ফয়সালা হবে রাজপথে।’
“প্রবীণদের পরামর্শ ও নির্দেশনা, সারাদেশে ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠক, আর বর্তমান প্রজন্মের শক্তি ও সাহসের সমন্বয়ে, গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই পুনরুদ্ধার করা হবে, বেহাত বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠা করা হবে মানুষের অধিকার। তারেক রহমান বলেন, যে কোনো আন্দোলন চুড়ান্ত পরিণতির দিকে নিতে হলে, ছাত্র-তরুণ ও যুবসমাজের ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে যেমন ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ প্রয়োজন। একইভাবে মাফিয়া সরকারবিরোধী এবং গণতন্ত্রকামী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোর নিজেদের মধ্যেও লিয়াজোঁ রক্ষা জরুরি।”
রিজভী বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে তারেক রহমান বলেন, দেশে চলমান যে সংকট এটি বিএনপির একক সংকট নয়। লগি-বৈঠাধারী কতিপয় নব্য রাজাকার কিংবা তাবেদার গোষ্ঠী ছাড়া, দেশে চলমান সংকট দেশের গণতন্ত্রকামী প্রতিটি নাগরিকের সংকট। কেউ নিরাপদ নয়।তাই, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ছাত্র-তরুণ-যুব সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে, খুনি লুটেরা চক্র এভাবেই কি ব্যর্থ করে দেবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ? নাকি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় পূর্বের মতো আবারো ঘুরে দাঁড়াবে ছাত্র-যুব সমাজ। সুতরাং, ‘আসুন, আপনার-আমার আমাদের সকলের তথা প্রতি নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা আবারো ঐক্যবদ্ধ হই। দেশ বাঁচাতে মানুষ বাঁচাতে আমাদের আন্দোলন ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক ,আব্দুস সালাম, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরাফৎ আলী সপু, আব্দুস সালাম আজাদ, ওমর ফারুক কাউসার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।