‘শিক্ষা ক্ষেত্রে অনিয়ম আর দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে’
এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পেতে সাড়ে তিন থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুস লাগে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন, শিক্ষক ও স্কুলের এমপিওভুক্তি সবখানেই টাকার খেলা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের এক প্রতিবেদনে দুর্নীতির এই তথ্য তুলে ধরে বলেছে, ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে অনিয়ম আর দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।’
টিআইবি ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনে দুর্নীতির খাতগুলো বিস্তারিত তুলে ধরছে।
তারা বলছে, অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা, সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দিতে পঞ্চাশ হাজার থেকে তিন লাখ, সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে নিয়োগ পেতে দুই থেকে তিন লাখ, শিক্ষক এপিওভুক্তি পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নীরিক্ষায় ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ, পাঠদান অনুমোদন এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ, স্বীকৃতি নবায়ন পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার এবং শিক্ষক বদলি এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা।
এইসব দুর্নীতির সাথে কারা যুক্ত তাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরর কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ম্যানেজিং কমিটি, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রধান শিক্ষক।
প্রতিবেদনে পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে মাউশির বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কার্যালয় ছাড়াও দেশের ১৮টি উপজেলার ৫৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ মনে করেন, ‘এই দুর্নীতি শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রন্ত করে। অযোগ্য লোক শিক্ষক, অধ্যক্ষ হয়ে যান। আবার মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন পায়। ফলে পুরো শিক্ষার মান নেমে যায়।’
তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য, ইউএনওরা মিলে আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দেন। টাকার বিনিময়ে চাকরি দেন। আর এটা দেখার দায়িত্ব যে শিক্ষা প্রশাসনের তারও এর সাথে জড়িত। ফলে যা হয় অযোগ্য শিক্ষক, অযোগ্য প্রতিষ্ঠান বেড়ে যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন তদন্ত করে এই অযোগ্য শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তার তালিকা প্রকাশ করা। আর দুর্নীতির সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা। ম্যানেজিং কমিটির নিয়মে পরির্তন এনে এমপি নয়, শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন। এমপি হলেই শিক্ষা বুঝবেন এমন কোনো কথা নেই। আর সদস্যরা তেমন লেখাপড়া জানেন না। শিক্ষার জন্য তাদের দরদ থাকে না। তাদের থাকে অন্য আগ্রহ।’
এই গবেষণার সাথে যুক্ত টিআইবির গবেষক তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘আমরা সুপারিশে বলেছি জাতীয় শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে। আর দেখেছি সিস্টেমটাই এমন যে ঘুস ছাড়া কাজ হয় না। এই সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে হবে। আর এখানে শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্ব আছে। তাদের কেউ কেউ এই দুর্নীতির সাথে যুক্ত। এখানে সিস্টেমটাই হয়েছে ঘুসের। মনিটরিং নেই। প্রশিক্ষণ থাকলেও তার ফলোআপ নাই।’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘এমপিওভুক্তি এখন অনলাইনে হয়। কিন্তু সেটা নামে মাত্র। পুরোপুরি এটা ডিজিটাল করা হয়নি। সফটওয়্যার ঠিকমত কাজ করে না। ফলে ম্যানুয়ালি কাজ করা হয়। সফটওয়্যার ঠিক থাকলে দুর্নীতি অনেকটা কমত। আগে পুরোপুরি কাগজে হত। তার চেয়ে এখন দুর্নীতি কমছে।’
তার মতে, জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই কাজ হচ্ছে না। দুর্নীতি শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে। এখন এমপিও শিক্ষকদের সুযাগ সুবিধা আগের চেয়ে বাড়ানো হলেও মান কমছে।
এ নিয়ে কথা বলার জন্য মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুকের সাথে চেষ্টা করেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে কয়েকবারই জানানো হয় যে, তিনি জরুরি মিটিং এ আছেন।