ফিলিস্তিনকে সমর্থন করায় ব্রিটেনের স্কুল শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার
সাম্প্রতিক সময়ে অধিকৃত ভূখণ্ড গাজা ও পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইলের সামরিক হামলার কারণে শুধু ব্রিটেনের রাস্তায়ই অসংখ্য বিক্ষোভ সংগঠিত হয়নি, দেশটির বিভিন্ন স্কুলে বিক্ষোভ হয়েছে। তুরস্ক ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা– আনাদোলু এজেন্সির বিভিন্ন প্রতিবেদন এ বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী আল–আকসা মসজিদ ও মসজিদ চত্বরে অবস্থানরত ফিলিস্তিনি মুসুল্লিদের ওপর হামলা আর গাজা উপত্যকায় বিমান হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনের বিভিন্ন স্কুলে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এসব বিক্ষোভ করারকারণে স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ছাত্রদেরকে বিভিন্ন বিড়ম্বনারও শিকার হতে হয়েছে। এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফিলিস্তিনের পতাকাকে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার আহ্বান স্বরূপ আর ইহুদিবিরোধিতার প্রতীক বলে আখ্যায়িত করেছেন।’ এ ধরনের মন্তব্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া ওই স্কুল শিক্ষকের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে এ প্রশ্ন তোলা হয় যে কেন শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা–ভাবনার প্রকাশ করার ক্ষেত্রে শাস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন।
অ্যালারটন গ্যারানজে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাইক রোপার একটি অনলাইন চিঠিতে বলেন, ‘এখানে সমস্যাটা হচ্ছে, প্রতীক ব্যবহার নিয়ে। যেমন বিক্ষোভের সময় ফিলিস্তিনের পতাকা ব্যবহারের ফলে এ বিক্ষোভ তার মূল বক্তব্য হারিয়ে ফেলেছে। কিছুলোক (ইহুদি) যখনই এ পতাকা দেখে তখনই তারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের অনিরাপদ বলে ভাবতে শুরু করে। আরতারা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আর অন্যরা এ পতাকাকে দেখে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার আহ্বান স্বরূপ। তারা (ইহুদিবিদ্বেষী) এ পতাকাকে ইহুদি বিরোধিতার প্রতীক বলে সমর্থন করে থাকে। এটা শুধু ব্রিটেনেই নয়। বিশ্বে অন্যান্য স্থানেও একই ধরনের ব্যাপার দেখাযায়।’
মাইক রোপার পরে তার বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি তার বক্তব্যের সমর্থনে বলেন, তিনি কোনো ছাত্রবা (ফিলিস্তিনি) জাতিকে কষ্ট দেয়ার জন্য এসব কথা বলেননি। পরে ওই প্রধান শিক্ষক ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।ছাত্র নেতাদের সাথে সাক্ষাৎকালে তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা করেন তিনি।
ওই স্কুলটি এখন নিজেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও দাতব্য সংস্থার সাথে কাজ করবে। মধ্যপ্রাচ্যে এসব সংগঠনের কার্যক্রমে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের সঙ্ঘাতের বিষয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করবে।
অ্যালারটন গ্যারানজে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাইক রোপার তার এক খোলা চিঠিতে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত।কারণ আমি ফিলিস্তিনের পতাকার বিষয়ে অনেক বিষয়ের সমন্বয়ে এমন একটি উদাহরণ দিয়েছি, যা এ সম্প্রদায়ের (ফিলিস্তিন ওমুসলিম) অনেককে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। তাদের কষ্ট দেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। গত সপ্তাহে এক পূর্ণাঙ্গ চিঠি ছাত্রদেরসাথে শেয়ার করা হয়েছে। ওই চিঠিতে আমাদের ছাত্রদের চিন্তা ও বিশ্বাস আর এসবের প্রতি তাদের প্রচণ্ড আবেগের প্রশংসা করাহয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে কিভাবে আমরা আমাদের ছাত্রদের সাথে জ্ঞানগতভাবে ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে এ (মধ্যপ্রাচ্যের) ইস্যুগুলোকে তুলে ধরতে কাজ করব।
অ্যালারটন গ্যারানজে স্কুলের ঘটনাই একমাত্র উদাহরণ নয়। ব্রিমিংহাম, ম্যানচেস্টার, রোচডেল আর লন্ডনের ছাত্রদেরও একই ধরনের মারাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ইস্ট লন্ডনের ক্যালাপটন গার্লস একাডেমিতে শিক্ষকরা ফিলিস্তিন ও তাদের সংগ্রমের সপক্ষের সকল পোস্টার ও বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলেছে। এ সময় শিক্ষার্থীরা স্কুলে একটি স্টেজ তৈরি করে ও ‘ফিলিস্তিনস্বাধীন’ কর বলে স্লোগান দিচ্ছিল। তখনই স্কুলের শিক্ষকরা এমন কাজ করেন।
ম্যানচেস্টারের লরেটো কলেজের ২০০ ছাত্র একটি বিক্ষোভের পরিকল্পনা করলে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তাদের কলেজটি বন্ধ করে দেয়। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিলেও সেখানকার ছাত্ররা আর স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের কলেজের গেটের সামনে সমবেত হন। তারা ফিলিস্তিনের পতাকা দোলান আর ফিলিস্তিনিদের পক্ষে স্লোগান দেন।
রোচডেলের ওল্ডার হিলের ফাঁস হওয়া একটি গোপন অডিও রেকর্ডে দেখা যায়, এক শিক্ষক তার সেভেন গ্রেডে পড়া ছাত্রকে ধমক দিচ্ছেন। ইসরাইলের সেনারা ফিলিস্তিনের শিশুদের হত্যা করায় ওই ছাত্র ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার সমর্থন ও সহানুভূতি দেখানোয় তার প্রতি এমন আচরণ করা হয়।
ওই অডিও রেকর্ড মতে, ওই শিক্ষক এটা অস্বীকার করেন যে ইসরাইলের বিমান হামলায় শিশুরা নিহত হচ্ছে। তিনি ওই ছাত্রকে অভিযুক্ত করেন তার বর্ণবাদী চিন্তার জন্য। তিনি ওই ছাত্রকে আরো বলেন, ফিলিস্তিনিদের অন্য কোথাও রেখে আসতে। তিনি তার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘প্রত্যেকেরই নিজের মতামত ধারণ করার অধিকার আছে…। কিন্তু স্কুলে এসব মতামত প্রকাশ করা চলবে না।‘
সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের শেখ জাররাহ এলাকা থেকে ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের উচ্ছেদে ইসরাইলি আদালতের আদেশের জেরে পবিত্র রমজান মাসে অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের ওপর মসজিদুল আকসা চত্বরে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী হামলা চালালে এ সঙ্ঘাতের রেশ পশ্চিম তীর, গাজাও ইসরাইলের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। ইসরাইলি যুদ্ধ বিমান ১০ মে থেকে গাজায় হামলা শুরু করে। গত শুক্রবার ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি আগ পর্যন্ত ১১ দিন হামলা চালিয়ে গাজার সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা গুলো বিধ্বস্ত করে দেয় ইসরাইলের বিমান বাহিনী।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, টানা ১১ দিনের ইসরাইলি হামলায় ৬৬ শিশু ও ৩৯ নারীসহ অন্তত ২৫৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামলায় আহত হয়েছেন আরো এক হাজার ৯৪৮ জন। এ ছাড়া পশ্চিম তীরে আরো ৩১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন ইসরাইলের হামলায়।
অপর দিকে ফিলিস্তিনিদের ছোড়া রকেট হামলায় ১৩ ইসরাইলি নিহত হন। গত শুক্রবার মিসর প্রস্তাবিত এক যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে এ সঙ্ঘাতের অবসান হয়।
সূত্র : মিডলইস্ট মনিটর