ব্যাংকারের আত্মহত্যা: সংবাদ সম্মেলনে পরিবার দুষল হুইপপুত্র ও পুলিশ কর্মকর্তাকে
চট্টগ্রাম–১২ আসনের সংসদ সদস্য ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে শারুন চৌধুরীসহ অন্য অপরাধীদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল মোরশেদ চৌধুরীর স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর–রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইশরাত বলেন, হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী ও সাবেক ছাত্রনেতা আরশাদুল আলম বাচ্চুর অব্যাহত চাপ, হুমকি ও হামলার কারণে নিরুপায় হয়ে ব্যাংকার আবদুল মোরশেদ চৌধুরী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ২০১০ সাল থেকে মোরশেদ তার আপন ফুফাতো ভাইদের সাথে ব্যবসা করছিলেন। কোনো নথিপত্র ছাড়া তারা মোরশেদকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ দেন। তিনিও তাদের ৩৫ কোটি টাকা শোধ করেন।২০১৮ সালের দিকে এসে তিনি ওই ব্যবসার কথা পরিবারের অন্যদের বলেন, তিনি আর ব্যবসাটা করতে চান না।
৭ এপ্রিল ব্যাংকার আবুল মোরশেদ চৌধুরী আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি চার পৃষ্ঠার একটি সুইসাইড নোট রেখে যান।এর একটি অংশে লেখা ছিল, ‘আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবে, আরেকটু দেখি, আরেকটু দেখি করতে করতে দেনার গর্তটা অনেক বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে। যারা কোনো টাকাই পেত না, তাদের দিতে গিয়ে এখন সত্যিকারের দেনায় জর্জরিত। বেঁচে থাকলে এই দেনা আরো বাড়বে। তা ছাড়া পরিচিত গুলোই এখন চেপে ধরেছে বেশি। এই লোড আমি আর নিতে পারছি না, সত্যি পারছি না।’
এই ঘটনায় শারুন চৌধুরীর আবির্ভাব ২০১৯ সালের মে মাসে বলে উল্লেখ করেন ইশরাত জাহান। মে মাসের এক দিন শারুনতার স্বামীকে (মোরশেদ চৌধুরী) ফোন করে রেডিসন হোটেলে দেখা করতে বলেন। মোরশেদ এতে আপত্তি করেন। তিনি বলেন, তার (শারুন চৌধুরীর) সাথে কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন নেই। তারপরও কেন তিনি দেখা করতে বলছেন। জবাবে শারুন চৌধুরী বলেন, ‘লেনদেন নেই, এখন হবে।’ এর কিছুক্ষণ পরেই শারুন আরো ১০ থেকে ১২ জন যুবককে নিয়ে তাদের বাসায় যান।ভিডিও ফুটেজে শারুনকে দেখা না গেলেও, মোরশেদের ফুফাতো ভাই পারভেজকে দেখা যায়। তাদের ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীদের আটকে রেখে ওই যুবকরা বলে, গাড়ির ভেতরে শারুন চৌধুরী বসে আছেন। ওই সময় মোরশেদ চৌধুরী বাসায় ছিলেন না। তিনিতার আত্মীয় আজম খানের বাসায় ছিলেন। আজম খানই লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করছিলেন। কিছুক্ষণ পরে শারুন চৌধুরী ও হাজির হন আজম খানের বাসায়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মোর্শেদ চৌধুরীর সাথে শারুন চৌধুরীর সরাসরি কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন না থাকলেও পারভেজ ইকবাল ও জাবেদ ইকবালের মাধ্যমে শারুন চৌধুরী ব্যবসার অর্থ বিনিয়োগ করেন বলে তিনি শুনেছেন। দেশজুড়ে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে শারুন আত্মগোপনে যান, এরপর থেকে তিনি আর সরাসরি কোনো বৈঠকে হাজির হননি।
সংবাদ সম্মেলনে ইশরাত জাহান চৌধুরী যে পুলিশ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কথা বলেন, তার নাম বিজয় বসাক। ওই সময় তিনি চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ উত্তরের উপ–কমিশনার ছিলেন। মোরশেদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিজয় বসাক টাকা আদায়ের কাজ তত্ত্বাবধান করেছেন।
ইশরাত বলেন, ২০১৮ সালে মোরশেদকে তার ফুফাতো ভাইয়েরা এম এম প্যালেসে আটকে রাখেন। তার মাথায় পিস্তল ঠেকান, পাসপোর্ট কেড়ে নেন এবং তাকেও বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা করেন। ওই সময় পাঁচলাইশ থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। এক বছর পর বাসায় হামলা হলে তারা সরাসরি উপ–কমিশনার বিজয় বসাকের সাথে দেখা করেন। তার নির্দেশে পাঁচলাইশ থানায় মামলা হয়। ওই ঘটনায় মোরশেদের ফুফাতো ভাই জাবেদ ইকবাল গ্রেফতার হন। তিনি জামিনে বেরিয়ে আসারপর বিজয় বসাকের সাথে দেখা করেন। বিজয় বসাক তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে একটি চুক্তিপত্রে সই করান। ওই চুক্তিপত্র অনুযায়ী মোরশেদকে ১২ কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। যদিও কেন এই টাকা দিতে হবে তা–ই বুঝতে পারছিলেন নামোরশেদ ও তার পরিবার।
সংবাদ সম্মেলন শেষে ইশরাত বলেন, এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন তারিখে কত টাকা মোরশেদকে ব্যাংকে জমা দিতে হবে, ঠিক করে দিতেন বিজয় বসাক। গত ১১ মার্চ বিজয় বসাক মোরশেদকে ফোন করে বাসায় ও ব্যাংকে পুলিশ পাঠিয়ে ধরেআনার হুমকি দেন। ওই অডিও রেকর্ডটিও সাংবাদিকদের কাছে রয়েছে।
ইশরাত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘একজন আইনের লোক হয়ে তিনি (বিজয় বসাক) কি এ কাজ করতে পারেন? তিনি আদালতে যেতে বলতে পারতেন। দোষী হলে মোরশেদের শাস্তি হতো।’
মোরশেদ চৌধুরীর মৃত্যুর পরদিন ইশরাত জাহান চৌধুরী চারজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরো সাত–আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। আসামিরা হলেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক জাবেদ ইকবাল, তার ভাই পারভেজ ইকবাল, নাঈম উদ্দীন সাকিব ও যুবলীগ নেতা শহীদু হক চৌধুরী রাসেল। মামলায় শারুন চৌধুরীর নাম উল্লেখ কেন করেননি জানতে চাইলে ইশরাত জাহান চৌধুরী বলেন, তিনি ভয়ে প্রথমে নাম উল্লেখ করেননি। এখন সব হারিয়ে মুখ খুলেছেন। সংবাদ সম্মেলনে মোরশেদ চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে, মা, ভাই ও ভাবি উপস্থিত ছিলেন।