অব্যবস্থাপনার কারণে করোনা ভয়ংকর বীভৎসতা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির: রুমিন ফারহানা

0

২০২১এর শুরু থেকেই ধাপে ধাপে চলছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সরকার তার মতো করে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করেছে। সেই সঙ্গে এখন চলছে বইমেলা। থেমে থাকেনি বিসিএস প্রিলিমিনারি এবং মেডিকেলে ভর্তিপরীক্ষা। স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ। তাই বলে থেমে থাকেনি সপরিবারে সমুদ্রভ্রমণ কিংবা বিনোদন কেন্দ্রে যাওয়া।এমনকি একটু লম্বা ছুটির সুযোগে দেখা গেছে কক্সবাজারে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জমায়েত। আসলে গত বছরের শেষ থেকে ইমানুষ ভুলতে বসেছিল করোনার কথা। শনাক্তও নেমে এসেছিল শতাংশের ঘরে। তাই সাবধানতার লেশমাত্র ছিল না কারওমধ্যে। না সরকারের, না সাধারণ মানুষের। স্থল, আকাশ কিংবা নৌপথে চলেছে মানুষের নিত্য আনাগোনা। পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্ত থেকে মানুষ এসেছে কোনো বাধা ছাড়াই। এই চরম অসাবধানতার ফল ফলেছিল মার্চের শুরুতেই, যখন করোনার গ্রাফঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়েছিল। সম্প্রতি থেকে সেটি একেবারে গগনচুম্বী।

এই সবকিছুর মধ্যেও মানুষ যদি যে যার জায়গা থেকে অন্তত ব্যক্তিগত সুরক্ষাটুকু নিশ্চিত করত, তাহলে অল্প দিনের ব্যবধানে শনাক্ত প্রায় ২৫ শতাংশে পৌঁছে যেত না। মূলধারার মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েক দিন ধরে ক্রমাগত কভিডে আক্রান্ত, মৃত মানুষের তথ্য; হাসপাতালে আইসিইউ, হাইফ্লো অক্সিজেন, এমনকি সাধারণ বেড পর্যন্ত খালি না থাকার খবরে পূর্ণহয়ে আছে। আছে নিকট আত্মীয় আর বন্ধু হারানোর হাহাকার। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখি মানুষ হাঁটছে, রিকশায় যাচ্ছে, গাড়িতে চড়ছে, বাসে উঠছে। ভিড়ের রাস্তায় গাদাগাদি করে কোনো মতে ঠেলে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। অধিকাংশের মুখে মাস্কের চিহ্নমাত্র নেই। যে অল্পকিছু মানুষ মাস্ক বহন করছে, তারাও সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করছে না। সর্বত্র একটা ঢিলেঢালা ভাব।

অথচ আমরা এমন একটা দেশে বাস করি, যেখানে করোনার বিশেষ চিকিৎসা দূরে থাক, হাসপাতালে আছে ডাক্তারনার্স, পর্যাপ্ত বেডের তীব্র সংকট। রাজধানীর বাইরে জেলা সদর গুলোর অবস্থা আরও করুণ। গত বছর যখন করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপনিয়েছিল, তখন সরকারের তরফে নানা উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল প্রতি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন। ১০ মাস আগে খোদ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন। অথচ দুঃখজনক খবর হলো, করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৩১ জেলার মধ্যে ১৫টিতেই আইসিইউ নেই। ওদিকে প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। রাজধানী তো বটেই, এমনকি জেলা সদর গুলোতেও।

অনেক ক্ষেত্রে করোনার জটিল রোগীদের আইসিইউর চেয়েও উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন বেশি। জন্য জেলা হাসপাতাল গুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র হাইফ্লো নাজাল ক্যানোলা থাকা প্রয়োজন। সংক্রমণ ঝুঁকির৩১টির মধ্যে অন্তত ৪টি জেলায় কোনো হাইফ্লো নাজাল ক্যানোলা নেই। অধিকাংশ জেলায় থেকে ৫টি করে নাজাল ক্যানোলা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে হাইফ্লো নাজাল ক্যানোলা রয়েছে ৭১৫টি।

সরকারিবেসরকারি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগী রাখার জায়গা নেই উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, বেড না হয় বাড়ালাম, কিন্তু রোগী আরও বাড়লে তাতেও লাভ হবে না। প্রতিদিন হাজার লোক আক্রান্ত হলে এবং সবাই হাসপাতালে এলে সারাদেশকে হাসপাতালে রূপান্তর করলেও রোগীর জায়গা দিতে পারব না। তিনি ঢাকায় জোরাজুরি না করে কাছের জেলা গুলোতে গিয়ে সেবা নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু কাছের জেলায় চিকিৎসার সেই সুবিধা কোথায়?

সম্প্রতি শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবর ভীষণভাবে নজর কেড়েছে সবার। এক সন্তানের বুকফাটা কান্না ভেজা ছবিতে খবরটির ক্যাপশন– ‘ হাসপাতাল ঘুরেও পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেলেন না, মা মারা গেলেন অ্যাম্বুলেন্সে।বাংলাদেশের মতো দেশে অতি খারাপ অবস্থায় চলে যাওয়া রোগী আইসিইউ না পেয়ে মারা যাওয়ার সান্ত্বনা হয়তো স্বজনরাপেতেও পারেন। কিন্তু শুধু পর্যাপ্ত অক্সিজেন দিতে না পেরে স্রেফ শ্বাস নিতে না পেরে মারা যেতে দেখা তার স্বজনদের জন্য কতটা মর্মান্তিক, সেটা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? শুধু অক্সিজেন দিয়ে একজন নাগরিককে প্রাণে বাঁচাতে না পারা উন্নয়নের গর্বকরা দেশটির জন্য কতটা ভয়ংকর অবমাননাকরসেটা কি বোঝেন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীনরা?

আমরা সময় পেয়েছিলাম। আমরা চাইলে সেটিকে কাজে লাগাতে পারতাম। স্বল্পোন্নত, নিম্নমধ্যম আয়ের এই দেশটিতে যেখানেএখনও অসংখ্য মানুষ দিন আনে দিন খায়, সেখানে উন্নত দেশের মতো চাইলেই যে লকডাউন দেওয়া যায় নাসেটা কি সরকারজানে না? আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা, হাসপাতালের অবস্থা, ডাক্তারনার্সের স্বল্পতাকোনটি অজানা সরকারের? এইভয়ংকর অতিমারির মধ্যেও তো সরকার পারেনি প্রতিটি জেলায় আইসিইউ দূরে থাক, হাইফ্লো অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ইউকে ভেরিয়েন্ট আবিস্কারের পর যখন সব দেশ ইউকে থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দিল, তখনও আমরা অবাধে ইউকে থেকে মানুষকে আসতে দিয়েছি। এমনকি তাদের জন্য ডব্লিউএইচও নির্দেশিত কোয়ারেন্টাইন পর্যন্ত নিশ্চিতকরিনি। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনকে বানিয়েছিলাম হোম কোয়ারেন্টাইন। এর ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। সংক্রমণ বিস্তারলাভ করেছে ভয়াবহভাবে।

একের পর এক অবহেলা, অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে করোনা ভয়ংকর বীভৎসতা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।আক্রান্ত, মৃত্যু আর বিনা চিকিৎসায় বিভিন্ন হাসপাতালে ঘোরার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আকাশ স্পর্শ করবে খুব নিকট ভবিষ্যতেই।এরপরও কি আমরা সরকারের ন্যূনতম টনক নড়া দেখতে পাব না?

লেখক: রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com