ইউরোপে সুযোগ যথেষ্ট, তবুও অবৈধপথে চেষ্টা
ইউরোপের দেশগুলোতে বৈধ অভিবাসনের ভালো সুযোগ আছে। ব্রেক্সিটের পর ইংল্যান্ডে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইতালিতেও সুযোগ বাড়ছে। তবু চলছে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা।
একটা সময় ডিভি ভিসা দিয়ে বাংলাদেশিদের মাঝে অ্যামেরিকা যাওয়ার ব্যাপক প্রবণতা ছিল। এখন বাড়ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রবণতা। শিক্ষা, উন্নত জীবন এবং ভালো আয়ের জন্যই এই প্রবণতা।
কিন্তু অনেকেই না জেনে অবৈধভাবে বা দালালদের মাধ্যমে বিকল্প পথে, বিশেষ করে তৃতীয় দেশ হয়ে সমুদ্র পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢোকার চেষ্টা করে নিজেরা বিপদে পড়ছেন, দেশের সুনামও ক্ষুণ্ন করছেন।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতেই বৈধভাবে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি গেছেন। এই সংখ্যা সরকারি হিসবে ৫০ হাজারের মতো। যুক্তরাজ্যে গেছে ১৫ হাজারের মতো। তার বাইরে অনেক দিন ধরেই সিলেট অঞ্চলের অনেক লোক সেখানে অভিবাসী হয়েছেন।
গত দুই-তিন বছরে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান জানান, ‘এ রকম অ্যাসাইলাম সিকার আছেন ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, সাইপ্রাসহ আরো কিছু দেশে। সবচেয়ে বেশি আছে ইতালিতে, ৩০ হাজার। অন্যান্য দেশে আছে ১০-১৫ হাজার করে।’
২০১৭ সালে ইইউ তাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশের সাথে স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তি সই করে। শরিফুল হাসান জানান, শুধু গত বছরই সমুদ্রপথে অবৈধ চার হাজার ৪২১ জন বাংলাদেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন।
অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন। পড়াশোনাও করেছেন ইংল্যান্ডে। তিনি জানান, ‘ইউরোপের মধ্যে সেরা হচ্ছে ইংল্যান্ড। সেখানে এখন পাঁচ বছরে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। বাবা-মা বাংলাদেশি হলেও সেখানে জন্ম নেয়া তাদের সন্তানরা এখন সহজেই ব্রিটিশ পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে।
পড়াশোনা করতে গিয়ে চার বছর থাকার পর কোনো চাকরিতে ঢুকলে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। আর বাংলাদেশি টাকায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে নাগরিকত্ব অল্প সময়েই পাওয়া যায়।’
পর্তুগাল ও গ্রিসও বিনিয়োগ ক্যাটাগরিতে নাগরিকত্বের সুযোগ দিচ্ছে। সেখানে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ দেখাতে হয়। এই বিনিয়োগ বাড়ি কেনা বা অন্য কোনো খাতে হতে পারে। তবে এত টাকা ব্যবসায়ী বা ধনী ছাড়া সম্ভব নয়। যাদের দ্বিতীয় একটা পাসপোর্ট দরকার হয় তারা এই সুযোগ নেন। ফলে পড়াশোনা করতে গিয়ে নাগরিত্ব নেয়াই সহজ। অনেক কম খরচ। আর ইতালিতে অনেক বছর কাজ করতে করতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে।
জার্মানিতে পড়াশুনার জন্য যাওযার সুযোগ আছে। তবে জার্মান ভাষা জানতে হয়। তবে ওখানে নাগরিকত্ব পাওয়া এত সহজ নয়। ইউরোপের দেশগুলোতে শিক্ষিত এবং দক্ষ লোকের জন্য কাজ আছে। তারা সহজেই রেসিডেন্ট পারমিট পায়, নাগরিকত্বও পায়।
যারা নানা কাজ আর উচ্চ বেতনের কথা বলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে লোক পাঠায়, তারা আসলে নিজেরাই জানে না ওইসব দেশে কোন ধরনের লোকের কাজের বা থাকার-সুবিধা আছে। তারা আসলে পুরো কাজটাই করে প্রতারণার জন্য। মানুষকে ঠকিয়ে টাকা আয় করার জন্য।
যারা জানেন, তারা নিজেরাই সব কাগজপত্র ঠিকমতো দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতে পারেন। কাজ পেতে পারেন। কোনো দালাল ধরার দরকার নেই। বিষয়গুলো বোঝার জন্য বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েব সাইট খেকে তথ্য নিতে পারেন। দূতাবাস থেকে নিতে পারেন। অথবা অভিজ্ঞ কারোর সহায়তা নিতে পারেন।
ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিন জানান, ‘ব্রেক্সিটের কারণে এখন ইংল্যান্ডে বাংলাদেশিদের জন্য অভিবাসন আরো সুবিধাজনক হয়েছে। ব্রেক্সিটের আগে ইউরোপীয়, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপীয় অনেক দেশের নাগরিক ইংল্যান্ডে নানা ধরনের কাজে যুক্ত ছিল। বাংলাদেশিদের অনেকেই সেখানে গিয়ে কাজ পেতেন না। রাস্তায়ও ঘুমাতে হয়েছে। কিন্তু ব্রেক্সিট হওয়ায় পর ইউরোপীয়রা সব চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশিদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তারা কাজ পাচ্ছেন।’
বাংলাদেশি যারা ইংল্যান্ডে যায়, তারা মেটামুটি শিক্ষিত। প্রচুর খাটতে পারে। ফলে তাদের সুনাম আছে। ইতালিতেও বাংলাদেশিদের কাজের সুনাম আছে। ইতালিতে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ করে নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিখাতে এখন তাদের লোক প্রয়োজন। এটাও বাংলাদেশিদের জন্য একটা সুযোগ।
ইউরোপের বাইরে কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ থেকেই আবেদন করে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। পয়েন্ট সিস্টেম আছে। নানা দক্ষতা এবং অবস্থার জন্য পয়েন্ট নির্ধারণ করা আছে। ছয় মাসের মধ্যেই নাগরিকত্ব পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায়। তারপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর ওই দেশে গিয়ে থাকতে হয় নাগরিকত্ব বহাল রাখার জন্য। ক্যানাডায় তিন বছরের মধ্যে আর ইউরোপের দেশগুলোতে পাঁচ বছরের মধ্যে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়।
এশিয়ায় আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়ও বিনিয়োগকারী হিসেবে বৈধ অভিবাসনের সুযোগ আছে। আরব আমিরাতে মাত্র পাঁচ হাজার ডলারে রেসিডিন্ট পারমিট পাওয়া যায়।
সাবরিনা জেরিন বলেন, ‘না জেনে, না বুঝে ঝাঁপ দেয়া ঠিক না। নিজের দক্ষতা আর যোগ্যতা বিবেচনা করেই ইউরোপে অভিবাসী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। অবৈধভাবে প্রবেশ করলে অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।’
পৃথিবীর যেসব দেশেই অভিবাসন প্রক্রিয়া কোনো গোপন বিষয় নয়। দূতাবাসের ওয়েবসাইট ও পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েব সাইটে তা দেয়া থাকে। অভিবাসন বিভাগ থেকেও তা জানা যায়। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ, যারা ইউরোপে যেতে চান, তার ইংরেজি পড়তে পারেন না বা বুঝতে পারেন না।
আবার অন্যান্য বিদেশি ভাষাও তারা জানেন না। ফলে এখানকার এজেন্সিগুলো নানা ভুয়া তথ্য দিয়ে তাদের ফুসলিয়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে। কোন যোগ্যতায় যাওয়া যাবে তা তারা জানেও না, বলেও না। এ কারণেই এখন অনেক দেশ জানাচ্ছে, নিয়ম মেনে আবেদন করলে তাদের দেশে বৈধ অভিবাসনের সুযোগ আছে।
এখানে বাংলাদেশের অভিবাসন মন্ত্রণালয়েরও অনেক দায় আছে বলে মনে করেন আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, ‘কোন দেশে কোন ধরনের লোকের অভিবাসনের সুযোগ আছে, কী যোগ্যতা প্রয়োজন তা প্রচার করা দরকার। মানুষ যেন জানতে চাইলে সহজেই তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন তার ব্যবস্থা করা দরকার।’ সূত্র: ডয়েচে ভেলে।