পিলখানা হত্যার ১ যুগ তবুও কাটেনি ধোঁয়াশা
আজ সেই ভয়াবহ পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবস। দীর্ঘ এক যুগ পেরিয়ে গেলেও কাটেনি ধোঁয়াশা। মিথ্যা অপবাদ নিয়ে অন্ধকার প্রকাষ্ঠে দিন কাটাচ্ছেন নিরাপরাধ বিডিআর সদস্য।
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদরদপ্তরে সংঘটিত হয় বর্বরোচিত এক হত্যাকাণ্ড। সেদিন শহীদ হয় বাংলাদেশের ৫৭ জন সেনা অফিসার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এত সেনা অফিসার শহীদ হয়নি। দুর্ঘটনাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে মোট ৫৫ জন অফিসার শহীদ হয়েছিলেন।
২৫ শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টা ২৭ মিনিটে শুরু হয় সেই কালো অধ্যায়ের। ওই দিন দরবার হলে চলমান বার্ষিক দরবারে একদল বিদ্রোহী বিডিআর সৈনিক ঢুকে পড়ে। এদের মধ্যে একজন বিডিআর মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা। বিডিআরের বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে, তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় তখন এক ভীতিকর বীভৎস ঘটনার সৃষ্টি হয়। এসময় বিদ্রোহীরা পিলখানার চারটি প্রবেশ গেট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশে-পাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকে। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়ে মেধাবী সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে।
৩৬ ঘণ্টার সেই হত্যাযজ্ঞে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
বিদ্রোহীদের হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় পুরো বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। এরপর শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোষাক, লোগো, সাংগঠনিক কাঠামো, পদোন্নতি ইত্যাদির পুনর্গঠন করা হয়। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় বিডিআর বিদ্রোহের আইন। বর্ডার গার্ড আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা রাখা হয় মৃত্যুদণ্ড।
এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ নিয়ে জনমনে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। বিডিয়ার বিদ্রোহের নামে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হলেও বিডিয়ার বিদ্রোহের আড়ালে অন্য কোন চক্রান্ত ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। মনে করাটা একেবারে অযাচিতও নয়। তৎকালীন বিভিন্ন বিষয়ই মানুষকে এমনটি ভাবতে বাধ্য করে। মানুষের মনে সৃষ্টি করে নানান প্রশ্নের। যে প্রশ্নগুলো আজো ঘুরে ফিরে দেশপ্রেমিক জনতার মনে।
ঘটনার দিন বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনার জন্য সরকার ব্যাপকভাবে পরিচিত সিনিয়র কাউকে না পাঠিয়ে দু’জন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন তা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। কেননা পরে প্রকাশিত হয়েছে বিদ্রোহের প্রধান হোতা ডিএডি তৌহিদ প্রতিমন্ত্রী নানকের সহপাঠী। এ ছাড়া পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অন্যতম শিকার বিডিআর’র ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী ও কর্নেল গুলজার ছিলেন র্যাবের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা এবং বিডিআর বিদ্রোহের সমঝোতা কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আজমের আপন ভগ্নিপতি, জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের গ্রেফতারে নেতৃত্বদানকারী। সুতরাং এই সন্দেহ দেখা দেয়াই স্বাভাবিক যে, বিডিআর বিদ্রোহের বিষয়ে তারা কি কোনো না কোনোভাবে জ্ঞাত ছিলেন বলেই সরকার নানক-আজমকে সমঝোতার জন্য নির্বাচন করেছিলেন?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশের আইজিও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্ধকার পিলখানার ভুতুড়ে পরিবেশে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে প্রশংসিত হলেও কিছু আত্মীয়পরিজন সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যকে নিয়ে ফেরত আসা এবং বাকি সেনা পরিবারের সদস্যদের বিষয়কে গুরুত্ব না দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মূল হুতা হল ভারত। বিডিয়ার বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে দিতেই ভারত এই ঘটনা ঘটায়। কেননা ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে বিডিআর-বিএসএফ যুদ্ধে ১৬ জন বিএসএফ জওয়ান মারা যায় (বিবিসি)। ঐ ঘটনার পরে ভারতীয় ডিফেন্স মিনিস্টার জসবন্ত সিং উত্তপ্ত লোকসভায় জানান, “এ ঘটনার বদলা নেয়া হবে।”
এ ছাড়া বিডিআর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ আরও ১১ জন সেনা কর্মকর্তার নিহত হবার সংবাদ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ন্ত্রিত চ্যানেল এনডিটিভিতেই সর্বপ্রথম প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ১৩ মিনিটে (২৫ ফেব্রুয়ারি) তারা খবরটি প্রচার করে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা যেখানে দুই দিনেও শাকিল আহমেদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারেনি, সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ঘন ঘন বিডিআর হেডকোয়ার্টারে যাতায়াত করে হত্যাকারীদের সাথে দফায় দফায় দেনদরবার করেও যেখানে গণহত্যার খবর পায়নি, এমনকি পরবর্তী দিন অর্থাত্ ২৬ ফেব্রুয়ারি (২০০৯) বাংলাদেশের কোনো দৈনিক এমন খবর প্রকাশ করেনি সেখানে সুদূর ভারতে বসে ভারতীয় মিডিয়া ১২ জন অফিসারের নিহত হবার বিষয়ে কি করে নিশ্চিত হল তা রহস্যের সৃষ্টি করে বৈকি? অনেকেই তাই প্রশ্ন করেন, তাহলে কি তাদের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টরা বিডিআর হেডকোয়ার্টারের ভেতরে অবস্থান করছিলো?
এ ছাড়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মন্তব্য ও বক্তব্য এবং সমরপ্রস্তুতি, বিশেষত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর বাংলাদেশে তথাকথিত ভারতীয় শান্তি-মিশন পাঠানোর প্রস্তাব এবং ইসলামী জঙ্গিদের এ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের প্রচারণা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতার ঈঙ্গিত করে।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরই ভারত অযাচিত কিছু স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রস্তাব দেয়। এসব প্রস্তাব যদি গ্রহণ কিংবা বাস্তবায়িত হয়, তা কেবল বাংলাদেশকে ভারতের গোলামে পরিণত করার প্রক্রিয়াকেই জোরদার করবে। এই প্রস্তাবগুলো হলো :
(১) বিডিআরের জন্য অর্থ প্রদান, (২) বাংলাদেশে যে কোনো ধরনের সাহায্য প্রদান, (৩) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারতীয় সেনা প্রেরণ, (৪) বিডিআর পুনর্গঠনে সহযোগিতা প্রদান। [দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা-ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০০৯]
২ মার্চ, ২০০৯ ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন আসামের জোড়াহাট বিমান ঘাঁটিতে বেশ কিছু যুদ্ধ বিমান প্রস্তুত ছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট (সর্বোচ্চ সর্তকতা) জারি করা হয়। আগ্রা থেকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এক ব্রিগেড প্যারাস্যুট বাহিনী কলকাতার নিকটবর্তী কালাইকুণ্ডায় আনা হয়। বাংলাদেশে একটি অভ্যন্তরীণ গোলযোগ চলাকালীন ভারতের এই সমর প্রস্তুতির রহস্য কি পিলখানার খুনিদের, বিশেষত মুখোশ পরিহিতদের উদ্বার করা, যারা রহস্যজনকভাবে বিডিআর সদর দফতরে প্রবেশ করে এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল?
ঘটনার পরে পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিহত বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল এর পুত্র রাকিন আহমেদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছিলেন জাতির সামনে। আজও তার প্রশ্নের উত্তর উন্মোচিত হয়নি। এ প্রশ্নগুলো থেকেও বুঝা যায় পিলখানা হত্যাকাণ্ড একটি পরিকল্পিত ঘটনা। যার সাথে জড়িত ছিল দেশীয় দোসরারাও। তার প্রশ্নগুলো পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
১) বিদ্রোহের ঘটার পর সেনাবাহিনী যখন উপস্থিত হয় তখন সরকার কেন ঢুকতে বাঁধা দিল ?
২) এটা একটা মিলিটারি সিচুয়েশন। এখানে সেনাবাহিনী ট্যাকল করবে। সেনাবাহিনী না পাঠিয়ে তারা (সরকার)কেন কোন ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই রাজনীতিক নেতাদের পাঠালো? নিরাপত্তা ছাড়া নেতাদের পাঠিয়ে সরকার কীভাবে এতো আত্মবিশ্বাসী ছিল? (কেননা বিদ্রোহীরা তো তাদেরকেও মেরে ফেলতে পারত)
৩) হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরেও আশেপাশের ৩কিলোমিটার জায়গায় কেন সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেয়া হল এবং জওয়ানদের পালাতে সুযোগ দেয়া হল?
৪) ৫৭ জন অফিসারকে খুন করে শরীরকে বিক্ষত করা হয়েছে, বেয়নেট দিয়ে খোচানো হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধেও আমরা এতো অফিসারকে হারাইনি। এখন প্রশ্ন জাগে, এই ঘটনার ২-৩ দিন আগে কর্ণেল গুলজারসহ আরো কয়েকজন চৌকস অফিসারকে তাড়াহুড়ো করে কেন র্যাব থেকে বিডিআরে আনা হল?
পিলখানা হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। ২০১৭ সালে বিচারের নামে নিরাপরাধ ১৩৯ বিডিয়ার সদস্যদের ফাঁসি ও ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন দেওয়া হলেও এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে দেশবাসীর।