‘মিশ্র শাসন ব্যবস্থা’ ও মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান

0

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই দুটি ঘটনা সর্বত্র আলোচনার সৃষ্টি করেছে। পয়লা ফেব্রুয়ারি আমাদের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে অং সান সু চির বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে সেখানকার সেনাবাহিনী। আর ৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা ইআইইউ বাংলাদেশের বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা মিশ্র শাসনের দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। একটি আরেকটির বিপরীত। একটি দেশের শাসনব্যবস্থা কেমন হবে এবং মানুষ কিভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগ করবে সেটি তাদের নিজস্ব বিষয়। বিশ্বব্যাপী দেশ শাসনের স্বীকৃত যত মতবাদ রয়েছে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই হলো তার মধ্যে উত্তম ব্যবস্থা। আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক ভিত্তি রচিত হয়েছে গণতন্ত্র দিয়ে। পৃথিবীর বহু দেশেই যুগে যুগে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মানুষ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে এবং তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার অধিকার মানুষের জন্মগত। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায় না। মানুষ মুক্তভাবে কথা বলতে ভালোবাসে এবং চলাফেরা ও চিন্তা করতে চায়।

মতপ্রকাশ অন্যের জন্য যতক্ষণ ক্ষতিকর বিবেচিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোও গণতান্ত্রিক অধিকার। বিশে^র দেশে দেশে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ সবসময়ই এই চেতনা ধারণ করেছে। অন্যের মতপ্রকাশে বাধা প্রদান কিংবা শক্তির জোরে তা হরণ করে নেয়া অগ্রহণযোগ্য। সভ্যসমাজে যা অকল্পনীয়। গণতন্ত্রেও হয়তো ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু সে ত্রুটি দূর করার পদ্ধতিও গণতন্ত্রে রয়েছে। কোনো রাষ্ট্রে একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের ভুলত্রুটি সংশোধনের বড় উপায় হলো ভিন্নমতের চর্চা। বিকল্প সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে হলেও তার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র না থাকলে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সম্ভব নয়। অন্যের অধিকারকে মেনে নেয়া কিংবা স্বীকার করে নেয়ার নামই গণতন্ত্র। নিজের বিরুদ্ধে গেলেও অন্যের মতপ্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যের একটি দিক। সহনশীলতা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সহিষ্ণুতাবিহীন পৃথিবী নৈরাজ্যের নামান্তর। বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রকাঠামো এর মূল চেতনাই ছিল গণতন্ত্র। অতীতের শাসকগোষ্ঠী এদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলে আজকের ইতিহাস হয়তো ভিন্নভাবে লেখা হতো। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলো- ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা অপসৃত হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ যে গণতন্ত্র প্রত্যাশা করেছে তার যাত্রা নিরবচ্ছিন্ন হয়নি। বারবার এদেশে মানুষের আকাক্সক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আজো এ থেকে মুক্তি মেলেনি।

ব্রিটেনকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার। এখন দেশে দেশে গণতন্ত্রের যে চর্চা তার উৎপত্তি ব্রিটিশদের হাত ধরেই। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংসদীয় রাজনীতির চর্চা ব্রিটিশ রাজনীতিরই একটি সংস্করণ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে দেশটির একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট প্রকাশকে তাই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আলোচিত হাইব্রিড রেজিম হিসেবে যা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে তা নিয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় ইতোমধ্যে অনেক লেখালেখিও হয়েছে এবং হচ্ছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, একটি দেশে মতপ্রকাশের অধিকার কতটুকু তা বিবেচনায় নিয়েই সেখানকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এর অনেকগুলো সূচক মিলিয়েই হাইব্রিড রেজিম নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক সেসব দেশকে হাইব্রিড রেজিম বলে বর্ণনা করা হয় যেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা আছে- সেখানে নিয়মিত নির্বাচনও হয় আবার রাজনৈতিক দমন-পীড়নও চলে। অর্থাৎ এসব দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা রয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে ইআইইউ এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। সেই তালিকার পর এই বছরই বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থান পেয়েছে। যদিও সংস্থাটি বলছে, বিশ্বের দেশগুলোর গণতন্ত্রের গড় স্কোর আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে।

সংস্থাটির গত বছরের গণতন্ত্রের তালিকায় ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ছিল ৮০তম। তবে এই বছরের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান চার ধাপ এগিয়ে হয়েছে ৭৬। তাদের বেঞ্চ মার্ক ১০ পয়েন্টের মধ্যে, এ বছর বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৯৯। ২০০৬ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। তখন বাংলাদেশের গড় স্কোর ছিল ৬ দশমিক ১১। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বের ১৬৫টি দেশের ওপর করা এই তালিকায় বাংলাদেশের মতো মিশ্র শাসন রয়েছে ৩৫টি দেশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় গণতন্ত্রের বিচারে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত ও শ্রীলঙ্কা। তালিকায় ভারতের অবস্থান ৫৩তম আর শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৬৮তম। ভুটান রয়েছে ৮৪তম অবস্থানে, নেপাল ৯২তম, পাকিস্তান ১০৫তম, মিয়ানমার ১৩৫তম অবস্থানে। সূচকের তালিকায় ৯ দশমিক ৮১ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে আইসল্যান্ড, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডস।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানও হয়েছে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশের তালিকায়। তালিকার সবচেয়ে নিচে রয়েছে উত্তর কোরিয়া। এ ছাড়া আরো আছে ডিআর কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সিরিয়া, চাঁদ, ইত্যাদি দেশ। পাঁচটি মানদণ্ডে ১০ পয়েন্ট ধরে বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি বিচার করে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এগুলো হলো- নির্বাচনী ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, সরকারের সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক অধিকার।

হাইব্রিড রেজিমের বৈশিষ্ট্য কী?

‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ এবং ‘স্বৈরতন্ত্রের’ মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা ‘হাইব্রিড রেজিম’ আসলে কী? ইআইইউয়ের গবেষণা পদ্ধতিতে সেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেÑ যেসব দেশে নির্বাচনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটে, যা নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিরোধী দল এবং প্রার্থীর ওপরে সরকারি চাপ খুবই সাধারণ ঘটনা। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়ে মারাত্মক দুর্বলতা দেখা যায়, যা ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকেও বেশি। দুর্নীতির বিস্তার প্রায় সর্বত্র এবং আইনের শাসন খুবই দুর্বল। সিভিল সোসাইটি দুর্বল। সাধারণত সাংবাদিকরা হয়রানি ও চাপের মুখে থাকেন এবং বিচারব্যবস্থাও স্বাধীন নয়।

সরকারের প্রতিক্রিয়া

এই প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে বর্ণনা করেছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক এই প্রতিবেদনের বিষয়ে বিবিসিকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি খুব ভালো। নিয়মিত নির্বাচন হয়। গণতন্ত্রের সবরকম চর্চা হয়, বাক স্বাধীনতা রয়েছে। একে হাইব্রিড রেজিম বলার কোনো কারণ নেই।’ তিনি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সমালোচনা করে বলছেন, ‘তারা এর আগেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। তারা যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেটা ভিত্তিহীন ও মনগড়া একটি প্রতিবেদন।’

ইআইইউয়ের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য যাই হোক না কেন, অভিযোগ অবশ্যই গুরুতর। বাংলাদেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উন্নয়নের গণতন্ত্র হিসেবে বিভিন্ন সময় উল্লেøখ করা হয়েছে। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে সুন্দর দিকটি হলো একটি ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন। মতপ্রকাশের বাধাহীন অধিকার। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির অবাধ চর্চা। বিগত কয়েক বছরে সে চর্চা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সামরিক বাহিনীর শাসন চলেছে, সেটি মিয়ানমার। ব্রিটেনের কাছ থেকে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে। এরপর থেকে গত ৭৩ বছরের ইতিহাসে সামরিক শাসন চলেছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। দেশটির রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর বিশাল প্রভাব রয়েছে। মিয়ানমার বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী।

কেন এই অভ্যুত্থান? বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৫ সাল থেকে পাঁচ বছরের জন্য অং সান সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) একটি বেসামরিক সরকার গঠন করলেও সেনাবাহিনীর প্রভাব থেকে সেই সরকার বেরিয়ে আসতে পারেনি। মিয়ানমারে সেনাশাসন অনেক পুরনো এবং দীর্ঘস্থায়ী। দেশটিতে স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন জেনারেল অং সান, যাকে দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মনে করে, দেশটিকে ঐক্যবদ্ধভাবে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা রয়েছে। নতুবা মিয়ানমার ভেঙে টুকরো হয়ে যেত। জেনারেল নে উইন ছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার। তার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হয় ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত।

১৯৬০ সালে বার্মায় একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনের পর উ নুর নেতৃত্বে আবারো একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওই সরকারও চলমান অস্থিরতাগুলো সামাল দিতে ব্যর্থ হয়।
ওই ব্যর্থতাকে পুঁজি করেই নির্বাচনের দুই বছরের মাথায় সেখানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সেই থেকে বিভিন্ন উপায়ে প্রায় ৫০ বছর ধরেই চলছে সামরিক শাসন। মিয়ানমারের সর্বশেষ সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সেনাপ্রধান নিজেই নিজের প্রধান। অর্থাৎ তিনি কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন।

২০০৮ সালে মিয়ানমারে একটি সংবিধান প্রণীত হয়। ওই সংবিধানে মিয়ানমারের সংসদে এক-চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। শুধু আসন সংরক্ষিত রাখাই নয়, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে। এ তিনটি বিষয় হচ্ছে- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরা মন্ত্রণালয় এবং সীমান্ত সংক্রান্ত বিষয়। মিয়ানমারে বর্তমানে যে সংবিধান রয়েছে, সেটি বেসামরিক সরকারের ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভেতরে এমন আশঙ্কা রয়েছে যে, রাজনীতি শক্তিশালী হলে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমে যাবে।

সে জন্য যারাই সামরিক জান্তার বিরোধিতা করছে, তাদের দমন করা হয়েছে। শক্তিশালী এক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করেছিল তৎকালীন সামরিক জান্তা। ওই নির্বাচনে অং সান সু চির নেতৃত্বে এনএলডি জয়ী হলেও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি সামরিক জেনারেলরা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ১৯৬২ থেকে টানা ২০১১ সাল পর্যন্ত শক্ত হাতে সরাসরি দেশ শাসন করে। দেশটির মোট জাতীয় বাজেটের ১৪ শতাংশ ব্যয় হয় সামরিক খাতে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ২০০১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বার্মার সাথে জাপান এবং ভারতের সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিল। তবে চীনের সাথে সম্পর্ক কিছুটা শিথিল থাকলেও ১৯৮৮ সাল থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। চীন হচ্ছে প্রথম দেশ যারা মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৮৮ সালে। তখন থেকে চীন এবং মিয়ানমারের মধ্যে জোরদার সম্পর্ক তৈরি হয়। এছাড়া আসিয়ান জোটে যোগদানের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। মিয়ানমারে সামরিক শাসন নিয়ে এসব দেশ কখনোই তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশটির বেসরকারি খাতের অর্থনীতিও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

দেশটিতে সরাসরি সামরিক শাসন চলার সময় অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু তাতে সামরিক জান্তার অস্ত্র সংগ্রহ থেমে থাকেনি। ওই সময় চীন এবং ইসরাইলের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে দেশটি।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতিসঙ্ঘ মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যের ডাক দিয়েছে। অন্যদিক সেনাশাসকরা অং সান সু চিসহ ক্ষমতাচ্যুতদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়াসহ আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো মিয়ানমারকে নিয়ে বৈঠকের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্ত পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব চীনের ভেটোতে পণ্ড হয়ে গেছে। বিশ্ব সম্প্রদায় বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া আর প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। বলা যায়, মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো এই অভ্যুত্থানের বিষয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিতাড়ন করা হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য যা বাড়তি বোঝা।

বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে, মিয়ানমারের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, শরণার্থী প্রত্যাবাসন নিয়ে দেশটির সাথে বোঝাপড়া অব্যাহত থাকবে। গণতন্ত্রের জন্য মিয়ানমারের জনগণের প্রত্যাশা যাই হোক না কেন, দেশটি উন্নত বিশ্বের মূলস্র্রোত থেকে বহুদিন যাবত দূরে। এখন নতুন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হলো তা নতুন সঙ্কট তৈরি করবে। আর এর স্বাভাবিক প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর পড়ার আশঙ্কা প্রবল। আপাতত সেনাবাহিনী এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করলেও অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারের সমর্থকরা এর বিরুদ্ধে কতটা জনমত গঠন ও তা কাজে লাগাতে পারবেন তার ওপরই দেশটির ভবিষ্যত নির্ভর করছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com