বাইডেন জমানা
২০ জানুয়ারি, বুধবার, ২০২১। ওই দিন আক্ষরিক অর্থেই ওয়াশিংটন ছিল আলো ঝলমলে। তিন দশকের মধ্যে প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের শপথের দিনটি ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। এমন দিনেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন জো বাইডেন। তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তার শপথের মধ্য দিয়ে হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ওয়াশিংটনে মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটাল ভবনের ওয়েস্ট ফ্রন্টে আয়োজন করা হয় শপথ অনুষ্ঠানের। স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ৪৮মিনিটে প্রধান বিচারপতি শপথবাক্য পাঠ করান বাইডেনকে। নিজের পরিবারের ১২৭ বছরের পুরনো বাইবেলের একটি কপি হাতে শপথবাক্য পাঠ করেন তিনি। প্রথা অনুযায়ী প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম শপথ নেন কমলা হ্যারিস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান ও প্রথম দক্ষিণ এশীয় হিসেবে এ পদে অধিষ্ঠিত হলেন কমলা।
পূর্বঘোষণা মতোই শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেননি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৮৬৯ সালে অ্যান্ড্রু জনসনের পর এই প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার উত্তরসূরির অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগদান থেকে বিরত থাকলেন। তবে উপস্থিত ছিলেন বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। অন্যদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন এবং সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, লরা বুশ ও হিলারি ক্লিনটন।
বাইডেনের রাজনৈতিক পথচলা খুব একটা মসৃণ ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্কার’র সাংবাদিক ইভান ওসনসের লেখা ‘জো বাইডেন: আমেরিকান ড্রিমার’ বইয়ে ফিরিস্তি রয়েছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে মনোনয়ন পেতে কতটা লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে বাইডেনকে। এই বইয়ের পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে বাইডেনের লড়াকু মনস্তত্ত্ব ও হাল না ছাড়া স্বভাব। এই কথা আরো জানা যায়, তার সাম্প্রতিক আত্মজীবনীতে। ‘প্রমিজ মি, ড্যাড’ হচ্ছে তার সেই আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। ২০১৫ সালে তার বড় ছেলে বিউ বাইডেন মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর বইটি দারুণভাবে আলোচিত হয়। এই বইয়ে রয়েছে পিতা-পুত্রের কিছু হৃদয়স্পর্শী কথোপকথন। মৃত্যুপথযাত্রী পুত্র তার পিতাকে বলেছিলেন, ‘কখনো হাল ছেড়ো না, বাবা।’ পুত্রকে দেয়া কথা রেখেছেন তিনি। হাল না ছাড়া বাইডেন এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন। তবে বিউয়ের মৃত্যুর কারণে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল তাকে।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওবামা প্রশাসনে টানা আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন বাইডেন। পূর্ণ মেয়াদে ছিলেন একজন সিনেটর। এরপর গত বছর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ জানান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি প্রায়ই পারিবারিক গুরুত্বের কথা বলে থাকেন। সঙ্গতকারণে সবার আশা, তার শাসনামলে বিশ্বের সব মানুষের কষ্ট বুঝবেন তিনি। শপথের পর অভিষেক ভাষণে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র্রে ইতিহাস ও আশার দিন শুরু হলো’।
নভেম্বরের ৩ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ফলের নেপথ্যে থেকে গেছে মৌলিক কিছু পরিবর্তনের সম্ভাবনা। প্রাথমিক যে পরিবর্তন, তা দৃষ্টিভঙ্গির। কূটনৈতিক স্তরে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব অনস্বীকার্য। সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের অভিব্যক্তিতে যে অসংলগ্ন মনোভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে অসৌজন্য প্রকাশ পেত, তা আর থাকছে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আমেরিকার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল বিশ্ব অর্থনীতি। রাজনীতি ও কূটনীতিও। কোভিড-আক্রান্ত বিশ্বে অর্থনীতির অগ্রগতি যেভাবে স্তব্ধ হয়েছে, ছন্দে ফিরতে সে অর্থনীতির যেমন সময় প্রয়োজন, তেমনি সঠিক দিশারও দরকার। প্রয়োজন সঠিক নেতৃত্বের। বাইডেনের যুক্তরাষ্টকে সেই দায়িত্ব অনেকাংশে পালন করতে হবে। অতএব সেখানে প্রয়োজন নীতি নির্ধারণে স্বচ্ছতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং অবশ্যই দ্রুততার সাথে তা নেয়ার ক্ষমতা। এখানে বাইডেন প্রশাসনের কাছে থেকে পরিণতমনস্কতা প্রত্যাশিত। দৃষ্টিভঙ্গির বদল প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে এসে পড়বে বাদবাকি বিশ্বের সাথে সম্পর্ক। কেমনতর হবে তা আগামী দিনে? প্রত্যাশা বিপুল হওয়ার অবকাশ নেই। কারণ, অতীত সাক্ষী, ডেমোক্র্যাট জমানাতেই অনেক দেশে অহেতুক যুদ্ধের অবসান হয়নি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তানে। আর ফিলিস্তিন সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেখান থেকে আরো ঘোর অন্ধকারের দিকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাতে আরো মদদ দিয়েছেন।
একথা মানতেই হবে, ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে শপথ নিলেন বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট পূর্বসূরির কাছ থেকে এমন দেশ পাননি, যেমনটা ট্রাম্পের কাছ থেকে পেলেন বাইডেন। কারণ, ট্রাম্পের চার বছরে মার্কিন বহুত্ববাদী সমাজে এমন কিছু দৃশ্যমান হয়েছে, যে বদল ঘটেছে; তা অন্য কোনো প্রেসিডেন্টের আমলে দেখা যায়নি। নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য ওই সব ক্ষত সারিয়ে তুলতে এবং ছিদ্র মেরামত করা কষ্টসাধ্য হবে। করোনায় ইতিমধ্যে দেশটিতে মারা গেছে চার লাখের বেশি মানুষ। আর ট্রাম্পের ‘উসকানিতে’ ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ভবনে হামলা চালান তার উগ্র সমর্থকরা। ফলে সমগ্র বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। বলা হচ্ছে, ট্রাম্পের মতো করে জনগণের মধ্যে বিভেদের দেয়াল গড়ে বিদায় নেননি আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট। শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও মার্কিন প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু করেন তিনি। এ সব বিষয়ই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাইডেন প্রশাসনের জন্য।
একথা বলা অসঙ্গত নয় যে, যেহেতু জো বাইডেন একজন পেশাদার রাজনীতিক, দেশে-বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদার যে ক্ষতি হয়েছে, তা তিনি পুনরুদ্ধারে মনোনিবেশ করবেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানে।
‘ট্রাম্পোক্যালিপস : রেস্টোরিং আমেরিকান ডেমোক্র্যাসি’ বইয়ের লেখক ডেভিড ফ্রাম ছিলেন ট্রাম্পের রাজনীতির সবচেয়ে কট্টর সমালোচক। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বক্তৃতা লেখক ছিলেন তিনি। বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে এক নতুন বিশ্বের সামনে দাঁড় করাবে বলেই ফ্রাম মনে করেন। তিনি বলেছেন, বাইডেন যদি সতর্ক না হন, তবে তিনিও ট্রাম্পের মতোই ভুল করবেন।
ট্রাম্পের নানা অসঙ্গতির ভার বহন করতে হবে বাইডেন প্রশাসনকে। যে কোনো উত্তরসূরির জন্য এটি পীড়াদায়ক। চার বছর ধরে নানা ধরনের শত্রু খাড়া করে সব সমস্যার জন্য তাদের দায়ী করা এবং কথায় ও কাজে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার যে রেকর্ড ট্রাম্প তৈরি করেছেন, তা ভাঙা সহজ নয়। মার্কিন সমাজে ট্রাম্প গভীরভাবে রেখে গেলেন বিভাজনের রাজনীতি। অনেকে মনে করছেন ট্রাম্পের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এর অবসান হবে। আসলেই কি তাই? এখানে একটি তথ্য জেনে রাখা প্রয়োজন। ট্রাম্প কিন্তু গতবারের চেয়ে এবার ৮০ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন। এতে বোঝা যায় ট্রাম্প যে মানসিকতা ধারণ করেন মার্কিন সমাজে সেই মানসিকতার লোকজন বেড়েছে। ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একশো কুড়ি বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করায়।
একদা জার্মানির একনায়ক হিটলারকে নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ছবিটি। ১৯৪০ সালের ১৫ অক্টোবর মুক্তি পেয়েছিল চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সেই ছবি। ব্যঙ্গাত্মক ধ্রুপদী এই চলচ্চিত্রে হিটলারের নৃশংসতার চিত্র হাসির আড়ালে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন চ্যাপলিন। চার্লির চেহারা হিটলারের সাথে মিল থাকায় ছবিটি হয়ে উঠেছিল আরো বাঙময়। এখন আর হিটলারের শাসন নেই। তবে দেশে দেশে নানা ছদ্ম নামে রয়ে গেছে সেই শাসন। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে পূর্ণ গণতন্ত্র আছে মাত্র ২৩টি দেশে। ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র আছে ৫২টি দেশে। ৩৫টি দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাইব্রিড রেজিম বা মিশ্র শাসন এবং ৫৭টি দেশে চলছে স্বৈরশাসন। ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং ব্রাজিলও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প কায়েম করতে চেয়েছিলেন নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। এই যে দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান এর অনুপ্রেরণা ছিলেন স্বয়ং ট্রাম্প নিজে। ছিলেন মদদদাতা। এক্ষেত্রে মিসরের সিসিকে পিঠ চাপড়ে বাহবাহ দিয়েছেন ডিক্টেটর হিসেবে। যেন ডিক্টেটরশিপ কোনো মহৎ আদর্শ। কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার উত্থান যেমন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে; ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনেও এক রূঢ় বাস্তবতা। যা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ থেকে বেড়িয়ে আসতে বাইডেন প্রশাসন কী পদক্ষেপ নেয়, এখন তা-ই গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, অনেক দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কের মতোই আচরণ করছে। তাদের মতে নির্বাচন হলো, গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা। সেটা হতে হবে অবাধ ও স্বচ্ছ। কিন্তু যেসব দেশে বেসামরিক একনায়কতন্ত্র আছে সেখানেও নিয়মিত নির্বাচন হয়। তথাকথিত ওইসব নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করে চলে। কারচুপি শুধু জাল ভোটের মাধ্যমেই হয় না, আরো নানা উপায়ে হয়। বাংলাদেশেও গত নির্বাচনের আগে রাতেই ভোটদানের ঘটনা ঘটেছে।
গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও কর্তৃত্ববাদী শাসকরা জনগণকে সহিংসভাবে দমনের চেষ্টা করে থাকেন। এতে ভোটাররা ভোট দেয়ার আগ্রহ হারান। আর কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ছকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গঠিত সংসদ তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যেই চলে। তারা নিরাপত্তা বাহিনীকেও নানা ধরনের আইনবহির্ভূত কাজে ব্যবহার করেন। বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন তাদের আজ্ঞাবাহী হয়। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে এবং গণমাধ্যমও নিয়ন্ত্রণের কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। এ সুযোগে দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসক ও একনায়করা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করেন কঠোরভাবে।
আশার কথা, বাইডেন দেশে দেশে চলা কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে তার দেশের অবস্থান নেয়ার অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেছেন। ক্ষমতাগ্রহণের পর প্রথমবারের মত ৪ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে প্রদত্ত ভাষণে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহ্যগত মিত্রদের গুরুত্ব দেয়াসহ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার এবং বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে পারস্পরি শ্রদ্ধা ও মর্যাদাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করবে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমঞ্চে আবার পদার্পণ করেছে এবং বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বৈশ্বিক সর্বজনীন অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং আইনের শাসনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হবে আমাদের শক্তির ভিত্তি; অবশ্য এই মূল্যবোধের অনেক বিষয়ও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাপের মুখে রয়েছে।
জো বাইডেন বলেন, আমেরিকা তার জোট পুনর্গঠন করতে মনোযোগী হবে। জোট হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সম্পদের মধ্যে একটি। কূটনীতিতে নেতৃত্ব দেয়া মানে, জোট ও অংশীদারদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। চীন সম্পর্কে বেশি কিছু না বলেই উল্লেখ করেন, চীনের অর্থনৈতিক পীড়ন মোকাবেলা করা হবে। মানবাধিকারের ওপর চীনের আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের নেতিবাচক দৌরাত্ম্য যুক্তরাষ্ট্র মোকাবেলা করবে।
পূর্বসূরির সব নীতি ঝেড়ে ফেলারও ইঙ্গিত দিয়েছেন বাইডেন। ইয়েমেন যুদ্ধকে ‘একটি মানবিক বিপর্যয়’ আখ্যা দিয়ে বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেন যুদ্ধে আক্রমণাত্মক সব সমর্থন বন্ধ করবে। এ বিষয়ে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের বিরোধ নিরসনে তার প্রশাসনের একজন কূটনীতিক নিয়োগ দেয়ার কথাও ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রে মানবিক আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ বাড়ানোর বিষয়েও তার নীতি তুলে ধরেছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে এ কথা বলা হয়, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখনো তার প্রশাসন গুছিয়ে উঠতে পারেননি। ঠিক এমন সময়ে তার প্রশাসন প্রথম কোনো বড় আন্তর্জাতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হলো। মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ঘটনা বাইডেনের সামনে প্রথম আন্তর্জাতিক পরীক্ষা হিসেবে হাজির হয়েছে।
মাত্র কয়েক সপ্তাহ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন জো বাইডেন, কিন্তু এর মধ্যেই দুনিয়া বিষয়ে তার মূল ভাবনাগুলো পরিষ্কার : স্বদেশে পুনর্গঠন, মিত্রদের সঙ্গে কাজ, কূটনীতিকে আলিঙ্গন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে অংশগ্রহণ আর গণতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি; এসবই তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ধারায় নিয়ে গেছে, তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প যা বাতিল করে দিয়েছিলেন।
বাইডেনের সাফল্য কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে, যার অনেকগুলোই আবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তবে ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির হামলা, রাজনৈতিক মেরুকরণ, জাতিগত বর্ণবাদ, ট্রাম্পের অদক্ষ মহামারী মোকাবিলা গণতন্ত্রের পক্ষে মার্কিন মোড়লীর কার্যকারিতা অনেকটাই খর্ব করেছে। বাইডেন বলতে বড় পছন্দ করেন, নিজের দৃষ্টান্তের জোরেই আমেরিকা পথ দেখাবে। তবে দুনিয়া আবার তারিফ করবে, তেমন একটা দৃষ্টান্তের জন্য হয়তো দুনিয়াকে আরো অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে।
আরো অধিকসংখ্যক উদ্বাস্তুর জন্য দেশের দরজা খুলে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন বাইডেন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক টিকার ডোজ বানিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহজলভ্য করা হবে। শুধু নৈতিকভাবেই যে কাজটা ঠিক তা নয়, নিজের স্বার্থেই বরং আমেরিকার এটা করা উচিত। কারণ, এটা কোভিডের অভিযোজনকে মন্থর করবে, বিদ্যমান টিকার কার্যকারিতাকে বর্তমানে যা হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে।
আইনের শাসন লঙ্ঘনের দায়ে রাশিয়া আর চীনের সমালোচনা করে বাইডেন ঠিকই করেছেন, তবে দেশ দুটিকে তিনি বাধ্য করতে পারবেন না। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞার দাম দিতে পুতিন আর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্র এ দুই দেশের যেকোনো একটার সঙ্গে তার সার্বিক সম্পর্ক মানবাধিকারের জন্য অসহায় করতে পারে না। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থও তাকে বিবেচনা করতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আরো পাঁচ বছরের জন্য নিউ স্টার্ট পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে এ বাস্তবতার ওপরই জোর দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
একই বাস্তবতা হংকং বা জিনজিয়াংয়ের সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতি আচরণ ইস্যুতে চীনকে চাপ দেয়ার ক্ষেত্রকেও সীমিত করবে। এমনকি বাইডেন যেখানে আইনের শাসনকেই কেন্দ্রীয় মার্কিন নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, ধরা যাক মিয়ানমার, সেখানেও হয়তো তিনি প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে পারেন, বিশেষ করে তাদের যদি বাইরের সমর্থন থাকে।
বলার চেয়ে প্রয়োগ যে কঠিন, চীনা নীতি এটাই প্রমাণ করবে। চীনা আচরণের কড়া সমালোচনা করেছেন বাইডেন। তবে আমেরিকার স্বার্থে শি সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহও ব্যক্ত করেছেন। সংক্রামক ব্যাধি ও জলবায়ু পরিবর্তন থেকে পরমাণু বিস্তার ও সাইবার স্পেসে আচরণ, বৈশ্বিক এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুনিয়াকে সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্য বাস্তবায়নেও একইভাবে বাধার মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র।
আরো অনেক জটিল সিদ্ধান্ত নেয়ার বাকি আছে। ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাক্সক্ষা বিষয়েও বাইডেন প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আছে এক বছর আগে তালেবানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সনদ নিয়ে কী করা যায়, সেই প্রশ্ন। আছে উত্তর কোরিয়ার সরকারের প্রশ্ন, যারা পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্রভা-ার বাড়িয়েই চলেছে।
৪ ফেব্রুয়ারি বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি একটা আকার পেয়েছে। এটার দ্বিপক্ষীয় হওয়াটা জরুরি, যখন সম্ভব হবে কংগ্রেসকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। বোধগম্য কারণেই মার্কিন মিত্ররা ভীত, চার বছর পর মানুষটা যদিও ফেরেননি, তবু আমেরিকানরা ট্রাম্পবাদে ফিরে যেতে পারেন। ভয় হলো, ট্রাম্প কোনো বিকার নয়, বরং আমেরিকা যা হয়ে উঠেছে তারই প্রতিরূপ। নির্বাহী কাজের মাধ্যমে শাসন করার প্রলোভনটা বোধগম্য। তবে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বাইডেনের উচিত গার্হস্থ্য রাজনীতি স্বদেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এই নীতির পুনরুজ্জীবিত করা।