মানবাধিকার ইস্যুতে কঠিন চাপে পড়তে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা
মানবাধিকার ইস্যুতে কঠিন চাপে পড়তে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এবং ভিকটিমদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘে নতুন একটি প্রস্তাব আনছে বৃটেন। এ জন্য বৃটেন ও অন্যরা একটি খসড়া প্রস্তাব বিতরণ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক পরিষদ (ইউএনএইচআরসি)-এর সদস্যদের মধ্যে। সোমবার ইউএনএইচআরসি’র চার সপ্তাহের বসন্তকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে জেনেভায়। এই অধিবেশন শেষে এই প্রস্তাব গৃহীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী এবং তামিল বিদ্রোহীরা নৃশংসতা চালিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এই গৃহযুদ্ধে সেখানে কমপক্ষে এক লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন।
বৃটেনের সাউথ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মিনিস্টার অব স্টেট লর্ড আহমাদ বলেছেন, এক দশকেরও পরে শ্রীলঙ্কায় নৃশংস গৃহযুদ্ধের পরে সব সম্প্রদায়ের ভিকটিমরা এখনো ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন। ওই যুদ্ধে তাদের প্রিয়জনকে হয়তো হত্যা করা হয়েছে, না হয় তারা নিখোঁজ রয়েছে। বৃটেনের নেতৃত্বে ‘কোর গ্রুপ অন শ্রীলঙ্কা’ গঠন করা হয়েছে। এর ৬ সদস্য দেশের মধ্যে রয়েছে জার্মানি ও কানাডা। লর্ড আহমাদ বলেছেন, শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন রকম সম্প্রদায় এবং বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে পুনরেকত্রীকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য নতুন এই প্রস্তাবটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
জাতিসংঘ ও অন্য দাতা সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গৃহযুদ্ধের শেষের দিকে কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই সংখ্যালঘু তামিল সম্প্রদায়ের। তাদেরকে ২০০৯ সালের মে মাসে হত্যা করা হয়েছে। তবে যুদ্ধ চলাকালে উভয়পক্ষ নৃশংসতা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস। যুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। বিদ্রোহী তামিল টাইগারদের মধ্যে যারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন বা ধরা পড়েছিলেন তাদেরকে জোরপূর্বক গুম করে দেয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে দায়ী করা হয়। তখন থেকে যেসব তামিল সদস্য নিখোঁজ হয়েছেন বা হত্যা করা হয়েছে, তাদের পরিবারগুলো ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি করে আসছেন। কিন্তু বেসামরিক জনগণকে টার্গেট করার অভিযোগ অব্যাহতভাবে প্রত্যাখ্যান করে আসছে শ্রীলঙ্কা সরকার। জোরপূর্বক গুমের অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করছে তারা।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তৎকালীন শ্রীলঙ্কান সরকার ২০১৫ সালে অভিযোগের তদন্ত করতে প্রতিশ্রুতি দেয়। বিদেশি বিচারকদের সমর্থন আছে এমন একটি যুদ্ধাপরাধের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের এমন প্রস্তাব থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। তিনি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই এই কাজ করেন। গত বছর তিনি তার সমর্থকদের নিশ্চয়তা দেন যে, যুদ্ধের নায়কদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার যুগের ইতি ঘটানো হবে। এর মাধ্যমে তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এখানে উল্লেখ্য, তার বড় ভাই মাহিন্দ রাজাপাকসের অধীনে গৃহযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন মাহিন্দ রাজাপাকসে। এ সময়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাবাইয়ার অধীনে সেনাবাহিনী ওই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হত্যাকা- চালায়। এতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তিনি এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। ইউএনএইচআরসি’র বর্তমান অধিবেশন শুরুর প্রাক্কালে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীনেশ গুনাবর্ধনে বিবিসিকে বলেছেন, সংবিধানের অধীনে কোনো জবাবদিহিতার বিরোধিতা করে না শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু আমাদের সংবিধান বিদেশি বিচারক অনুমোদন করে না।
ওদিকে বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী সরকারের হাতে বর্তমান সরকারের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক ভিক্টিমাইজেশনে পরিণত করার বিষয় তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছেন গোটাবাইয়া রাজাপাকসে।
গত মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট এক রিপোর্টে বলেছেন, গৃহযুদ্ধের প্রায় ১২ বছর শেষেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং পুনরেকত্রীকরণে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে শ্রীলঙ্কা। কোনো ফল আনতে পারেনি তারা। আরো গভীরভাবে বলা যায়, দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভিকটিমদের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস জন্ম হয়েছে। তার এই রিপোর্ট এ সপ্তাহের শেষের দিকে জাতিসংঘের কাউন্সিলে জমা দেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, কমিশনের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে, বাস্তবে পরিস্থিতি পুরোপুরি তার চেয়ে ভিন্ন। এ জন্য মিশেল ব্যাচেলেটের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে শ্রীলঙ্কা। দ্বিমত পোষণ করে প্রমাণপত্র, তথ্যপ্রমাণ, বিস্তারিত রিপোর্টের বিষয়ে। তার খসড়া রিপোর্টের জবাবও দিয়েছে শ্রীলঙ্কা।
অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, অধিকারকর্মী এবং যারা এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চাইছেন, তাদেরকে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী ভবানী ফনসেকা বলেছেন, যদি আপনি উত্তর থেকে পূর্বে যান, তাহলে এমন পরিস্থিতি অনেক বেশি দেখবেন। সুশীল সমাজের সংগঠনের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে পরিদর্শন করে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো। এটা একরকম হয়রানি।
এ মাসের শুরুর দিকে মুসলিম, তামিল এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ একটি বিশাল র্যালি বের করে। তারা পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে অগ্রসর হয়। কারণ, কোভিড-১৯ এর জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তারা এই র্যালি করেছে। এই র্যালির মাধ্যমে তারা তাদের কষ্ট, বেদনা, ক্ষোভের কথা ফুটিয়ে তুলেছে। তামিলরা তাদের দাবি তুলেছে গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। অন্যদিকে মুসলিমদের অভিযোগ, করোনা মহামারির সময় কোনো মুসলিম মারা গেলে, জোরপূর্বক তাদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলেছে সরকার। এটা ইসলামের বিরুদ্ধ আচরণ। তামিলরা বলেছেন, বর্তমান সরকার পুনরেকত্রীকরণ এবং জবাবদিহিতা পর্যায়ক্রমিকভাবে হেয় করে আসছে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, গত বছর প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে একজন সেনা সদস্য সুনীল রতœায়েকে’কে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছেন। বেসামরিক আট তামিলকে হত্যার জন্য তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। ২০০০ সালে সে উত্তরের জাফনা অঞ্চলে মিরুসুভিলের এক গ্রামে ৫ বছর বয়সী একটি শিশু ও দুটি টিনেজকে সহ ৮ জনকে হত্যা করে।