পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন : ২৭ ভাগ মুসলমান যখন ৫০ শতাংশ আসনের নিয়ন্ত্রক

0

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই মুসলিম ভোট ব্যাংক নিয়ে আলোচনা জোরালো হচ্ছে। ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন আধার ইন্ডিয়ার ২০২০ সালের মে মাসের হিসেবে অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। যার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৪৭ লাখ।

ভারতে জনসংখ্যার দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান চতুর্থ। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৭১ শতাংশ হিন্দু এবং প্রায় ২৭ শতাংশ মুসলিম। তাই ভোটের মাঠে এই দুই ধর্মের মানুষদের প্রাধান্যই বেশি। তবে হিন্দুদের ভোট নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও বরাবরের মতো এবারও নির্বাচনে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে কাজ করবে মুসলিম ভোট ব্যাংক৷ সংখ্যালঘু মুসলিমরাই মূলত পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাদের উপর ভর করেই তৃণমূল কংগ্রেস দুইবার ক্ষমতায় বসেছে। এর আগে সিপিএমেরও ক্ষমতায় টিকে থাকার রসদও ছিল মুসলমানরা।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় মোট আসন সংখ্যা ২৯৪টি। এর মধ্যে প্রায় ১২৫টি আসনে ফলাফল নির্ভর করে মুসলমানরা কোন দলকে ভোট দিবেন তার উপর। ২০১৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনে এই ১২৫ আসনের মধ্যে ৯০টিতে জয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসে মমতার ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস। যা ২০১১ সালের নির্বাচনের চেয়ে ৫টি আসন কম। সেই নির্বাচনে অবশ্য কংগ্রেসের সাথে জোট গঠন করেছিল তৃণমূল। ২০০৬ সালে সিপিএম যখন সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ী হয় তখনও ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল এই ১২৫টি আসনে দেওয়া মুসলমানদের ভোট। সেই নির্বাচনে বামপন্থীরা ২৩৫টি আসন জিতেছিল, যার মধ্যে বিশেষ এই ১২৫টি আসনের ১০২টি জয় পায় তারা।

কিন্তু সাচার রিপোর্ট প্রকাশের পর মুসলমানদের পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। পাশাপাশি সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ঘটনাও সিপিএমের পতনের কারণ। ভারতে মুসলমানরা কেমন আছেন তা জানার জন্য ২০০৬ সালে বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একটি কমিটি গঠন করেন। সাচার রিপোর্ট প্রকাশের পর মুসলমানরা বুঝতে পারেন সিপিএমকে ভোট দিয়ে দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় রেখেও তাদের উন্নতি বলতে কিছুই হয়নি।

উন্নয়নের নানান সূচকে ভারতে মুসলমানরা পিছিয়ে যে আছেন, রিপোর্টের এই তথ্যে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার তথ্য দেখে অনেকেই চমকে যান। তৎকালীন বামপন্থী সরকার রিপোর্টের ফলাফল হজম করতে পারেনি, নিজেদের অকর্মণ্যতা ঢাকতে চেয়েছিল, এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে মুসলমানদের বাঁচানো হচ্ছে— এই বলে। দাঙ্গা ও দৈহিক হিংসার হাতে থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা রক্ষা পেলেও, রিপোর্ট থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা কেবল পিছিয়েই নয়, চরম অবহেলার শিকার।

সাচার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি উচ্চপদে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র ৪.৭ শতাংশ এবং মোট সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ মাত্র ২.১ শতাংশ। এসব তথ্য জানার পরই মূলত মুসলমানরা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে যায়। মুসলিম ভোট ব্যাংকের উপর নির্ভর করে দুইবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তার আমলে মুসলমানদের ভাগ্যের চাকা কতটুকু ঘুরেছে?

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ব্যুরো অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস অ্যান্ড স্ট্যাটিকস’ যে ‘স্টাফ সেন্সাস রিপোর্ট : ২০১৪-১৫’ প্রকাশ করেছে তাতে দেখা গেছে ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের অংশীদারিত্বের হার ৫.৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়লেও তা হচ্ছে একেবারেই কচ্ছপ গতিতে। এ থেকে পরিষ্কার যে মমতা ব্যানার্জির আমলেও মুসলমানদের আহামরি তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। মুসলমানদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখনো ওয়াকফ পদ্ধতিতে চলছে।

এবার রাজনীতির মাঠে মুসলমানের বাড়তি গুরুত্বের বিষয়টি আরো সূক্ষ্মভাবে দেখে নেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ৪৬টি আসনে ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি ভোটার মুসলিম। ৪০-৫০ শতাংশ মুসলিম ভোটার রয়েছে ১৬টি আসনে, ৩০-৪০ শতাংশ মুসলিম ভোটার রয়েছে ৩৩টি আসনে এবং ৫০টি আসনে মুসলিম ভোটারের সংখ্যা ২০-৩০ শতাংশ। এই ১৪৫টি আসনের মধ্যে অন্তত ১২৫টি আসনে মূল খেলোয়াড় হিসেবে ধরা হয় মুসলমানদের। এর মধ্যে মুর্শিদাবাদ, মালদা ও উত্তর দিনাজপুর জেলা মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় সেখানে ভোটের মাঠে মুসলমানরাই সর্বেসর্বা।

বাকি যে আসনগুলো রয়েছে সেখানে মুসলমানরা হচ্ছে ট্রাম্পকার্ড। এই আসনগুলো যে হিন্দু ভোটার রয়েছেন তারা মূলত তিন-চার ভাগে বিভক্ত হয়ে তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপিকে ভোট দেন। কিন্তু মুসলমানদের অধিকাংশ ভোট সাধারণত এক দলই পেয়ে থাকে। আগে পেয়েছে সিপিএম ও কংগ্রেস। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে অধিকাংশ মুসলিম ভোটারের প্রথম পছন্দ তৃণমূল। কিছু কিছু আসনে তারা কংগ্রেসকেও ভোট দেন। তবে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস যত বেশি দুর্বল হয়েছে মুসলমানরা ততবেশি তৃণমূল ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এতদিন পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলের আসনে সিপিএমকে দেখা হলেও আগামী নির্বাচনে তারা সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে মসনদে বসতে পারে বিজেপি। সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের আসনে থাকবে তৃণমূল। যদিও বিভিন্ন জরিপে আবারও তৃণমূলের ক্ষমতায় যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে আগের দুইবারের মতো এবার আর মমতার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সহজ হবে না।

কেননা পশ্চিমবঙ্গে হটাৎ করে আসাদউদ্দিন ওয়েইসি আর পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির উত্থান ঘটেছে। তারা দুজনই চেষ্টা করছেন মুসলিম ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে। এই দুজনকে নিয়ে মমতা ব্যানার্জির চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ এই দুই মুসলিম নেতা যদি অনেকগুলো আসনে প্রার্থী দেন তাহলে বেকায়দায় পড়তে হবে তৃণমূলকে। কারণ হিন্দু ভোট তো কম বেশি সব দলই পাবে। কিন্তু মুসলিম ভোটাররা হচ্ছেন মমতার খাসতালুক। সেখানে যদি খাবলা মারতে পারেন তবে তা ওয়েইসি আর আব্বাস সিদ্দিকিই পারবেন। তাদের প্রার্থী হয়তো জিততে পারবে না। কিন্তু যে ভোটগুলো তারা কাটবে সেটাই তৃণমূলের প্রার্থীদের পরাজয়ের কারণ হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে আসাদউদ্দিন ওয়েইসি আর পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি কতটুকু সফল হতে পারবেন?

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com